হাশেম ও কাশেম মিয়ার মধ্যে একেবারে দা-কুড়াল সম্পর্ক। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। তবে হাশেমের ছেলে নিউটন ও কাশেমের ছেলে সাব্বিরের মধ্যে খুব ভাব। আজও তারা একসঙ্গে খেলছে। সাব্বির একটা টেনিস বল আকাশে ছুড়ে মারছে আর ক্যাচ ধরছে। পাশে দাঁড়িয়ে তা দেখছে নিউটন। হঠাত্ সাব্বিরের মনে হলো, সে তো বলটা আকাশের দিকে ছুড়ে মারছে, তাহলে বলটা নিচে নামছে কেন? নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনো ব্যাপার আছে। সে নিউটনকে বলল, ওই, বল তো ওপরে মারতেছি, সেইটা আবার নিচে নামে ক্যান? নিউটন বলল, আরে ব্যাটা, নিচে না নামলে বলটা আবার ওপরে মারবি কেমনে? ওপরে উইঠা গেলে বাপে পিটাইব। আর তো খেলাই হইব না, তাই নিচে নামে। নিউটনের কথায় খুব একটা ভরসা না পেয়ে সাব্বির বাসার দিকে হাঁটা দিল। বাসায় গিয়ে তার বাবাকে বলল, আব্বা, বল নিচে নামে ক্যান?
বল নিচে নামে ক্যান মানে? মশকরা করো? থবড়ায়ে কান ফাটায় দিব।
সাব্বির আবার বলল, আব্বা, এই যে বল, এইটা ওপরের দিকে মারলে আবার নিচে নাইমা আসে। ক্যান? মনে হয়, মাটি বলরে টানে। কাশেম কয়েকবার গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে বলটা আকাশে ছুড়ে দেখল। তাই তো, বল ঠিকই মাটিতে এসে পড়ে। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাশেম বলল, শাবাশ ব্যাটা! তুই তো দারুণ জিনিস বাইর করলি রে। যাই, এইটা নিয়া হাসান মাস্টারের সঙ্গে কথা বইলা আসি।
হাসান মাস্টার এখানকার স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক হলেও সে সব বিষয়ই পড়ায়। চায়ের দোকানে কাশেম মিয়ার কাছে সব শুনে সে বলল, আপনি যে আবিষ্কারের কথা বলছেন, তা অনেক আগেই নিউটন আবিষ্কার করে ফেলেছে।
কী কইলা? নিউটন এইটা আগে আবিষ্কার করছে? হাশেমের পোলা? মাস্টার! তোমারে আমি ভালো লোক ভাবতাম। কিন্তু এখন দেখলাম আমার রং হইছে। হাশেমের মেয়ের সঙ্গে তোমার কিঞ্চিত্ প্রণয় আছে বইলা তুমি তার ছোট ভাই নিউটনের সাপোর্ট নিয়া কথা কইবা, এইটা তো ঠিক না!
আপনি ভুল বুঝছেন, আসলে…
আরে রাখো ভুল! শোনো, পোলার আবিষ্কারের কথা আমি সবাইরে জানামু। টিভি-পত্রিকার লোক খবর দিমু, পত্রিকায় ছবিসহ খবরও ছাপা হবে—বিস্ময় বালক সাব্বিরের মহা আবিষ্কার। তখন বুঝবা, আমার নাম কাশেম মিয়া। কাশেম মিয়া চলে যেতেই হাশেম মিয়া এসে বলল, কী মাস্টার, ওই কাশেম মিয়ার সঙ্গে কী এত কথা কইলা?
আর বলবেন না, কী যে ঝামেলা! উনি বলতে চাচ্ছেন, তাঁর ছেলে একটা তত্ত্ব আবিষ্কার করেছে। কিন্তু উনি জানেন না যে এটা অনেক আগেই নিউটন আবিষ্কার করে বসে আছে। একে বলে মাধ্যাকর্ষণ সূত্র।
কী কইলা? নিউটন আগে আবিষ্কার করছে?
জি।
মাস্টার! তোমারে অনেক ধন্যবাদ! বহুদিন পর একটা ভালো খবর দিলা! আমার পোলা সূত্র আবিষ্কার করছে! অথচ আমি জানিই না! তাই তো কই, পোলায় চুপচাপ বইসা কী এত ভাবে? এখন বুঝলাম সে এইসব নিয়া ভাবে। তুমি বসো, চা খাও। আমি আসতেছি। ওই, মাস্টাররে এক কাপ ডাবল মালাই চা দে।
নিউটনের বাবা বেরিয়ে যেতেই মাস্টার মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। হায় হায়! এ দেশের হবে কী! কোন লেখক যেন বলেছিলেন পল্লি গ্রামের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে সাহিত্য! ওই লেখক ভুল লিখেছিলেন। কিসের সাহিত্য? পল্লিগ্রামে ছড়িয়ে আছে বেকুব! একেবারে খাঁটি বেকুব।
এদিকে কাশেম মিয়া বাড়িতে এসেই চিত্কার করতে লাগলেন। মাস্টাররে আমি খাইছি। ব্যাটা দালাল! ওই, তোরা সবাইরে নিউজ দে, বিকালের মধ্যে সব টিভি-পত্রিকার লোক যাতে আমার বাড়িতে হাজির থাকে। তাড়াতাড়ি, কুইক!
আর মাস্টারের কাছে আবিষ্কারের কথা শুনে হাশেম মিয়া তো মহা খুশি। কাউকে সামনে পেলেই বলছেন, খবর শুনছ? আরে মিয়া, আমার পোলা তো বিরাট সূত্র আবিষ্কার করছে। ও তো নোবেল প্রাইজ পাইব। আরে, ওবামা সাহেব যেইটা পাইছে। আমার পোলারটা দেইখা কাশেমের পোলাও এই সূত্র শিখছে। আর কাশেমরে তো চিনই। এখন ও কয়, ওর পোলা নাকি আগে করছে। যা-ই হোক, অনেক কাম আছে, মাইকিং কইরা সবাইরে জানাইতে হবে। দোয়া রাইখো।
দুপুরের মধ্যে পুরো গ্রামের লোক ঘটনা জেনে গেল। দলে দলে লোক আসতে লাগল হাশেম মিয়ার বাড়িতে। উঠানের ঠিক মাঝখানে পাটির ওপর নিউটনকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তার মাথার ওপর একজন ছাতা ধরে আছে। সবাই এসে নিউটনকে দেখে বলে, দেখছ, কেমুন জ্ঞানী পোলা। কেউ কেউ সাহস করে জিজ্ঞেস করে, বাবা, তুমি কী আবিষ্কার করছ? তুমি যে আবিষ্কার করছ, তাতে কি আগামী বার ফসল ভালো হইব? এই বছর তো ফসল ভালো হয় নাই! নিউটন কিছু না বুঝে এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে।
এদিকে কাশেম মিয়া তো রেগেমেগে পুরো আগুন। সে তার লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে হাশেম মিয়ার বাড়ির দিকে রওনা দিল। একজন জিজ্ঞেস করল, কাশেম, বাঁশ নিয়া যাও কই? কাশেম মিয়া বলল, হাশেইম্মার লাশ ফেলতে যাই। হাতে বাঁশ, ফেলব লাশ। ডেডবডি!
কাশেম লাঠিসোটা নিয়ে আসছে, এই খবরে হাশেম মিয়াও লোকজন নিয়ে তৈরি। গ্রামের লোকজন যে-যার ঘরে ঢুকে গেল। টানটান উত্তেজনা। দূর থেকে কাশেমের দল দেখেই হাশেম আওয়াজ দিল, হুঁশিয়ার! কাশেম, আর এক পা আগাইলে কিন্তু মাইরা নলি ভাইঙ্গা ফেলব। কাশেমও পাল্টা হাঁক দিল, তুই কী নলি ভাঙবি? তোর নিজেরই তো নলি নাই!
এই বলে দুই দল পরস্পরের ওপর যেই আক্রমণ করতে যাবে, তখনই সিনেমার নায়কের মতো সেখানে হাজির হলেন স্কুলের হেডস্যার আর হাসান মাস্টার! হেডস্যার চিত্কার করে বললেন, খামোশ! একটা সামান্য বিষয় নিয়ে তোমরা কী শুরু করলা?
কাশেম মিয়া বলল, স্যার, এইটা সামান্য বিষয় না, আমার পোলা সাব্বির আগে আবিষ্কার করছে, সবাইরে খবরও দিছি, দুইটা টিভি চ্যানেল রওনাও দিয়া দিছে। আপনি ওই হাসান মাস্টারের কথা শুইনেন না। ওই ব্যাটা একটা পিওর দালাল!
হাশেম মিয়া বলল, স্যার, আপনি ওই মূর্খ কাশেমের কথা বিশ্বাস করবেন না, হাসান মাস্টার নিজে কইছে, আমার পোলা নিউটন আগে আবিষ্কার করছে।
খামোশ! তোমাদের আমি যত বেকুব ভাবছিলাম তোমরা তার চেয়ে বেশি বেকুব। বেকুবদের মাথায় গোবর থাকে, তোমাদের মাথায় তো তাও নাই। আরে, এই নিউটন না, আরও নিউটন আছে। সে হইল সকল নিউটনের রাজা আইজ্যাক নিউটন। বিরাট বড় বিজ্ঞানী। বহু বছর আগে সে এই সূত্র আবিষ্কার করছে। এই তো কয়েক দিন আগে তার ৩৬৭তম জন্মবার্ষিকী পালিত হইল। হাসান মাস্টার ঠিকই কইছে। এই নিউটন তোমার পোলা না। সে হইল সব স্যারদের স্যার। বুঝতে পারছ?
হাশেম লজ্জিত কণ্ঠে বলল, জি স্যার, বুঝছি! আমার ভুল হইছে। কাশেম বলল, হ্যাঁ, স্যার! আমারও মিসটেক হইয়া গেছে। আসলে আমরা দুইজনই লেখাপড়া শিখি নাই তো, তাই এত বড় মিসটেক হইল।
হেডস্যার হাসিমুখে বললেন, যাক, ভুল বুঝতে পারছ, এইটাই তো অনেকে পারে না। তোমরা তোমাদের ছেলেদের স্কুলে ভর্তি করায় দাও। ওরাও একদিন বিজ্ঞানী হইব। তবে হাশেম, যার নামে তোমার ছেলের নাম রাখছ, সেই লোকটারেই চেন না? এইটা কেমনে সম্ভব?
হাশেম মাথা নিচু করে বলল, স্যার, নামটা ওর মামায় রাখছে। কিন্তু নামের মাজেজাটা জিজ্ঞেস করা হয় নাই। নামের মাজেজা আইজ আবিষ্কার করলাম।
আদনান মুকিত
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ১১, ২০১০
Leave a Reply