২০০৯ সালটা কেমন গেল জানতে হলে যুক্তরাষ্ট্র এ বছর সবাইকে কেমন রেখেছে, সেটা জানাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করলে যে কেউ জানতে পারবেন। প্রতিবছর সবচেয়ে বেশি কৌতুক, গল্প তৈরি হয় মার্কিন প্রেসিডেন্টকে নিয়ে। জর্জ ডব্লিউ বুশকে নিয়ে যত গল্প আছে, তা লিখলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। কিন্তু ২০০৯ সাল তো বারাক ওবামার সময়।
কেউ বিশ্বাস করবে না, এক বছরে ওবামাকে নিয়ে মাত্র দুটি গল্প বা কৌতুক চালু হয়েছে। দুটি ঘটনাই সত্যি। তার পরও তা শুনে মানুষ হাসছে। এর মধ্যে একটি বছরের সেরা রাজনৈতিক কৌতুক—শান্তিতে এ বছর নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বারাক ওবামা। এটাকেই বছরের সেরা কৌতুক মানছেন অনেকেই।
শান্তিতে নোবেল দিলেই তো হবে না। বারাক ওবামা সেটি নিতে নরওয়ের রাজধানী অসলোয় যেতে সময় পাবেন কি না, তা নিয়েও জল্পনা-কল্পনা ছিল ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। কারণ দুটি যুদ্ধ চালাতে হচ্ছে তাঁকে। ওবামার শান্তি পুরস্কার নেওয়ার এত সময় কোথায়। যাক, শেষ পর্যন্ত খানিকটা সময় বের করতে পেরেছিলেন তিনি।
এ সুযোগে একটা ভবিষ্যদ্বাণী করা যেতে পারে। সেটা হলো বারাক ওবামার নোবেল জয় কিন্তু ২০০৯ সালেই শেষ নয়। ২০১০ সাল বা আরও সামনে কেমিস্ট্রি বা রসায়নে ওবামা নোবেল পেয়ে গেলে কেউ অবাক হবেন না যেন। অনেক মার্কিনই বিশ্বাস করে, তিনি সেটা পাবেন। নোবেল কর্তৃপক্ষও হয়তো মানে। জানেন তো, শান্তিতে নোবেল পাওয়ার সময় নোবেল কমিটি কী বলেছে? বলেছে, ‘হি হ্যাজ জাস্ট গট গ্রেট কেমিস্ট্রি।’ সুতরাং ভবিষ্যতে কেমিস্ট্রিতে যে ওবামাই নোবেল পাচ্ছেন, তা ধরেই নিতে পারেন।
এবার দ্বিতীয় গল্পটা বলি। বহু আগে কোনো একজন ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে একজন কালো মানুষ প্রেসিডেন্ট তখনই হবেন, যখন শূকরেরা উড়তে শুরু করবে। ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন কালো মানুষ বারাক ওবামা, আর বিশ্বজুড়ে দেখা দিয়েছে সোয়াইন ফ্লু। ইংরেজিতে ফ্লু বানানটা একটু ঘুরিয়ে ছবি আঁকা হচ্ছে উড়ন্ত শূকরের।
টাইম সাময়িকীর হিসাবে, ২০০৯ সালে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই আক্রান্ত হয়েছে চার কোটি ৭০ লাখ মানুষ। আতঙ্কে ছিল বাংলাদেশের মানুষও। কিন্তু সোয়াইন ফ্লু চূড়ান্ত ফ্লপ করেছে বাংলাদেশে এসে।
বাংলাদেশে মানুষ বেশি, সোয়াইন ফ্লু ছড়াবে দ্রুতগতিতে—এমনটি মনে করেছিল অনেকে। কিন্তু সে রকম কিছু হয়নি। ভেজাল খেয়ে খেয়ে এ দেশের মানুষের প্রতিরোধক্ষমতা হয়তো অনেক বেশি বেড়ে গেছে, আর তাতেই নাকি এখানে পাত্তা পেল না সোয়াইন ফ্লু। ভেজাল খাওয়ার উপকার তো পাওয়া গেল অবশেষে।
২০০৯ সালের আরেকটি বড় ঘটনা ছিল বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা। মাটির ব্যাংকে পয়সা রাখার অভ্যাস অনেকেরই আছে। তবে ধনী দেশে তেমন দেখা যায় না। আমেরিকায় সে রকম একজনকে খুঁজে পাওয়া যায়। শোনা যাচ্ছিল, তাঁকেই নাকি ২০০৯ সালের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হবে অর্থনীতিতে। সঞ্চয় ধরে রাখার এই একটাই উদাহরণ খুঁজে পাওয়া গেছে ২০০৯ সালে।
তবে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা আতঙ্ক যেমন ছড়িয়েছে, আশাবাদীও করেছে অনেককে। ১৯৮০ সালে ভারতের অন্যতম বড় শিল্পপতি আম্বানি ভাইদের ঋণ দেয়নি ভারতের আইডিবিআই ব্যাংক। সেই আম্বানি ভাইয়ের একজন এখন ব্যাংকটি কিনে নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। সুতরাং পাঠক-পাঠিকা, আপনারা আশাহত হবেন না। ব্যাংক যদি এখন ঋণ না দেয়, আরেকটা বিশ্বমন্দার জন্য অপেক্ষা করুন। একদিন হয়তো ব্যাংক কিনে নেওয়ার ক্ষমতাই আপনাদের হয়ে যাবে।
শুধু সোয়াইন ফ্লু নয়, বিশ্বে আতঙ্ক ছড়ানো আরও একটি বিষয় এবার খুব একটা পাত্তা পায়নি বাংলাদেশে। সেটি হলো বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা। বিশ্বে একে একে বন্ধ হয়েছে বড় বড় ব্যাংক। দেউলিয়ার হাত থেকে বাঁচাতে বিভিন্ন সরকারকে দিতে হয়েছে কোটি কোটি ডলার। গোল্ডম্যান স্যাক্স নামের একটি বিখ্যাত বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বলেছে, বিশ্বের চারটি দেশ অর্থনীতির মন্দা মোকাবিলায় সবচেয়ে বেশি দক্ষতা দেখিয়েছে। আর এ চারটি দেশের মধ্যে একটি হলো বাংলাদেশ। তবে এটা নিয়ে বছরের সেরা কৌতুকটি করেছে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। গত রোজার ঈদে তারা ঘোষণা দেয়, মন্দায় তাদের অবস্থা এতটাই খারাপ যে ঠিকমতো বেতন-ভাতাও দিতে পারবে না। পরে অবশ্য পোশাক ব্যবসায়ীদের কাউকেই রাস্তাঘাটে হাত পাততে দেখা যায়নি।
বাংলাদেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে ২০০৯ সালেই। আর বিভ্রান্ত করার কাজটি সফলতার সঙ্গে করেছে সরকার। যে অস্ত্র দিয়ে কাজটি করা হয়েছে সেটি হলো ‘ডে লাইট সেভিং’। ঘড়ির কাঁটা এগোনো হলো এক ঘণ্টা। রহিমের কথাই ধরি। প্রতিদিনের মতো ঘুমানোর সময় বিছানায় গেল, ঘুম এল না, বিছানার এ-পাশ ও-পাশ করতে হলো এক ঘণ্টা। সকালে ঘুম ভাঙতেই মনে হলো পুরো ঘুম হয়নি। আবার রাতের খাওয়ার সময় দেখা গেল, রহিমের আসলে ক্ষুধাই পায়নি, তার পরও খেতে হলো। সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দিল সন্ধ্যায়। সন্ধ্যা যেন আর শেষ হতে চায় না। দীর্ঘ সন্ধ্যা কাটাতে শরীরের ও ঘরের বাড়তি জ্বালানি খরচ করতে হলো রহিমকে।
তবে বছরের সেরা কৌতুকটি কিন্তু করেছে জামায়াতে ইসলামী। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে এই দলটির নেতাদের বড় অংশের বিচার করা উচিত বলে মনে করে দেশের মানুষ। তারাই এই বিজয়ের মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দেওয়ার ঘোষণা দেয়। তাদের আমির দাবি করেন, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাঁদেরও ভূমিকা আছে। আরেক নেতা তো আরেক ধাপ এগিয়ে। তিনি বলেছেন, রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে তাঁরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে এই কৌতুকের জবাব দেওয়া ছাড়া কি-ই বা আর করার আছে।
নিউ ইয়ার্স রেজুলেশন বা নতুন বছরের অঙ্গীকার বলে একটা কথা পশ্চিমে খুব চালু আছে। এটা বাংলাদেশেও চালু করা প্রয়োজন। হাত ধোয়া দিবস যদি হতে পারে, তাহলে এটা হতেই বা দোষ কী। আসুন, অঙ্গীকার করি—
১. দিনে ছয় ঘণ্টার বেশি ফেসবুকে থাকব না (টাইম সাময়িকীর হিসাবে ২০০৯ সালে নতুন করে ২০ কোটি মানুষ ফেসবুকের সদস্য হয়েছে)।
২. অতীতের স্মৃতি রোমন্থন না করে ভবিষ্যত্ নিয়ে দুশ্চিন্তা করব (যেমন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে ভাবনা)।
৩. কাজে ফাঁকি দিতে একই অজুহাত বারবার দেব না, নতুন কিছু বের করব (নতুন নিয়মে রাস্তার জ্যাম মনে হয় একটু কমেছে)।
৪. দিনে চারটার বেশি হিন্দি সিরিয়াল দেখব না (এক চ্যানেলে চারটার বেশি সিরিয়াল এক দিনে হয়)।
৫. পানির অপচয় করব না (পানির অনেক দাম। নাসা চাঁদে পানি খুঁজে পেয়েছে। এক গ্যালন পানি খুঁজে পেতে নাসার খরচ হয়েছে তিন লাখ ৩৮ হাজার ৪৬১ ডলার)।
৬. কৌতুক শুনে হাসব (মন্ত্রীদের বক্তৃতা নিয়মিত শুনলেই তো চলে)।
৭. ভালো গান শুনব, বেশি বেশি বই পড়ব (তোমার পাঞ্জাবিটা জোস/ আমার দোপাট্টাও সুন্দর/ তাই আমরা হলাম আজ/ ডিসকো বান্দর…)।
৮. জ্বালানি সাশ্রয় করার উপায়গুলো মুখস্থ রাখব (২০১০ সালেও জ্বালানি সমস্যার সমাধান হচ্ছে না)।
৯. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইব (২০১০ সালে হবে?)।
১০. ২০১০ সালে একই অঙ্গীকার করব (ভদ্রলোকের এক কথা)।
সবশেষে পুরোনো একটা গল্প বলি—
প্রশ্ন: ২০০৯ সাল কেমন গেল?
উত্তর: ২০০৮-এর চেয়ে খারাপ, কিন্তু ২০১০ সালের চেয়ে ভালো।
শওকত হোসেন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২৮, ২০০৯
Leave a Reply