পুরুলিয়ার জনৈক ভদ্রলোক নিম্নলিখিত দুইখানি পত্র ‘শনিবারের চিঠি’তে প্রকাশিত করিবার জন্য পাঠাইয়াছেন। প্রথমখানি পিতার, দ্বিতীয়খানি পুত্রের।
পিতা মানভূমবাসী, শুকলাল মাহাত নামক একজন কৃষিজীবী। পুত্র শ্রীমান গরাচাঁদ মাহাত, কলিকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের দ্বিতীয় বার্ষিক শ্রেণীতে পড়ে। লেখাপড়া যত না হউক, আধুনিক তারুণ্য আয়ত্ত করিতে তাহাকে বিশেষ বেগ পাইতে হয় নাই। পিতা ও পুত্রের মধ্যে পত্রের আদান-প্রদান ছিল এবং এখনও আছে, যেহেতু খরচটা পিতার কাছ হইতে যায়।
বলা বাহুল্য শুকলাল মাহাতর অবস্থা মন্দ নহে। বার্ষিক কমপক্ষে দশ-বার হাজার টাকা আয়। কিন্তু তাহার চালচলনে তাহা বুঝা যায় না। মানভূমের কৃষিজীবীদের দেখিয়া তাহাদের অবস্থা সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য প্রকাশ করা যায় না।
পিতার পত্র
শ্রীশ্রীরাধাগোবিন্দ নিতাইহরি
স্মরণং
বিড়ালখেদা,
মানভূম।
গুরুবার, আশ্বিনের এগার দিন।
আশীর্বাদং বিশেষ পরে,
হাঁমেদর গাঁয়ের রোঘনাথ মাহাত কুকুরগড়া যাঁয়ে রঁহেন। কুকুরগড়ার জমীদারলে তুমার কুশলটী মাঙ্গে আনিয়ে রঁহেন। সাঁঝেরবেলি তুমার খতটী আল। হাঁমেদর গাঁয়ে দেবতা কৃপাবর্ষণটী নাই করেন, মেনেক কাল বেলাডুবিএ টুক্চা বার্ষিল। শুকা, গড়াবাদি, হাজাধান ইবছরে নাই হবেক। কুকুরগড়ার জমীদার খাজনার তরে লক্ ভেঁজিয়ে রহেন। বল্লি, নাই দিতে লার্ব। কুথালে পাব? লক্টায় মোকর্দমা করবেক্ বলিঁএ চাঁলিঁয়ে গেলেছন্।
তুমার বাপের আজও খাতে নাই, আর কালও নাই। হামি টাকা কড়ি কুথায় পাব? হাঁমি গরিব, হাঁমি চণ্ডাল। তুমি দিনাক লবাব হোছ। লেখিন্ ভাল হবেক্ নাই। হাঁমেদর গাঁয়ের চাঁমুখুড়া বিদ্বান্ লক্ বঠেন। উনারেই কাছে শুনে রহি যে তুমি পড়াশুনাটী নাই কর। কেনে কর নাই? বাবুছাদের হনুকরণটী কৈরহো না। মাথার ঘামিট টঁস্টঁসাই গিরেছ, লেখিন্ তুমি বুঝ নাই। হাঁমাদের উকীলছা কলকাতায় পড়ছেন। উনার দুকুড়ি দশ টাকায় হবেক্, আর তোমারেই কেনে নাই হবেক্? অত্না চালাকী নাই করিস। ভাল হবেক্ নাই, বলে দিছি। হামি তিন কুড়ি টাকার বেশি নাই দিতে লারব। হামার টাকা কুথায়? তুমার মায়ের হিচ্ছাতেই অথায় তুমাকে ভেজে রহি। আর বেশী নাই লিখব। হামার আর তুমার মায়ের শ্রীচরণের ধুলা লিবে। রজ একটি খত দিবে।
ইতি
শ্রীল শুকলাল মাহাত বাবু সিংমুড়া,
সাং, বিড়ালখেদা
পোঃ কুকুরগড়া
থানা পুরুলিয়া
জেলা মানভূম।
পুত্রের উত্তর
Hindu Hostel
পয়লা অক্টোবর, ১৯২৯
রাত্রি এগারোটা
Governor,
তোমার চিঠি পেলুম। তোমার এরকম চিঠি একেবারেই expect কর্তে পারিনি। আমায় দু’একদিনের মধ্যে টাকা পাঠিও, নতুবা আমি বন্ধু ও বান্ধবীদের কাছে মুখ দেখাতে পারবো না। যদি তোমার টাকাই না ছিলো, আমাকে এখানে না পাঠালেই পার্তে! তোমার ‘উকীল ছা’ বাধ্য হয়ে ৫০ টাকায় চালায়, কারণ সে তার বাপের মতোই সেকেলে ভূত। তোমায় warning দিচ্ছি আমায় এমন করে আর চিঠি দিওনা। তোমার ঐ জমিদারি সেরেস্তার পচা বালি-কাগজের চিঠি যদি গীতিগন্ধ গাঙ্গুলী কিংবা মলয়হিল্লোল সেন দেখত তারা কি রকম idea পোষণ করত তা তুমি বুঝতে পারছ না বোধ হয়। বুঝবেই বা কোথা হতে? অজ পাড়াগেঁয়ে যাকে বলে।
গাঁয়ের ‘চামু খুড়াকে’ ব’লো যে সে যদি আমার সম্বন্ধে কোনও কথা বলে, আমি তাকে জেলে দেবো।
আমার ষাট টাকার এক পয়সা কমে মাস চলতে পারে না। আমার সিনেমা খরচই দশ বারো টাকা, তারপর তরুণ সাহিত্যিক বন্ধুদের মধ্যে মধ্যে Tea party দিতে হয়, তারও একটা খরচ আছে ত!
তুমি আধুনিক সভ্যতার কিছুই জান না। দু’একটা cinema দেখলে কিছু শিখতে পার, কিন্তু তোমার অদৃষ্ট খারাপ, চিরদিন লাঙ্গল ধরতেই গেল। Europeএ love কি রকম ভাবে কর্তে হয়, কোনখানে কি ভাবে কথা বলতে হয়, কোনখানে কি ভাবে দাঁড়াতে হয়, এগুলো শিখতে হ’লে তোমার ‘বিড়াল খেদায়’ শেখা হয় না। তাছাড়া, আমরা তরুণ, আমাদের সাহিত্যের খোরাকের জন্যও ওসব দরকার।
আরেক কথা, এখানকার Barrister Mr. Talapatra. তাঁর স্ত্রী ও তাঁর কন্যা Darjeelingএ যাচ্ছেন— তাঁদের সঙ্গে আমার চেনা না থাকলেও শুনেছি তাঁরা আমাদের মাসিক পড়েন, সুতরাং আমাকেও দার্জিলিং নিশ্চয় যেতে হবে। এজন্য কমেস কম তিনশো টাকার দরকার। পত্র পাঠমাত্র টাকা পাঠাও, নতুবা যাক্।
আর কিছু লেখবার নেই। তোমাদের শ্রীচরণের ধুলো নিয়ে মাথায় জটা বেঁদে গেল। ওসব বাজে মামুলি কথা ছেড়ে দিয়ে কাজের কথা দুলাইন লিখলেই চলে।
ইতি
yours sinly
G. mathew
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২৮, ২০০৯
Leave a Reply