১৪ ডিসেম্বর সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশের উদ্দেশে ইরাকি সাংবাদিক মুনতাজার আল জাইদির জুতা নিক্ষেপের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে লেখাটি ছাপা হলো।
জুতামামার অনেক দুঃখ। সব সময় পায়ের তলায় থাকে বলে রাস্তাঘাটের ময়লা-আবর্জনা, ইট-পাথর, কাদাপানি ইত্যাদি সহ্য করতে হয়। এ দুঃখ তার আর সয় না। এই দুরবস্থা থেকে মুক্তির জন্য সে সৃষ্টিকর্তার কাছে ফরিয়াদ জানাল, ‘হে ঈশ্বর, কী এমন অপরাধ করেছি যে তার জন্য আমার এই দুরবস্থা? কেন কেউ আমাকে উপযুক্ত সম্মান দেয় না?’
জুতামামার আর্জি শুনে ঈশ্বর কিছুটা লজ্জিত হয়ে বললেন, ‘তোমার কোনো দোষ নেই। আসলে মানুষের এত উপকার করেও তুমি তোমার উপযুক্ত সম্মান পাও না। বলো, তুমি কী প্রতিদান চাও?’
এমন সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে জুতামামা বিধাতার কাছে আবদার করে বললেন, ‘আমাকে এমন সম্মান দান করো, যাতে আমি ইতিহাসের অংশ হতে পারি। যাতে করে সবাই আমাকে নিয়ে মাতামাতি করবে, গান গাইবে, কবিতা লিখবে, উপন্যাস রচনা করবে, খবরের কাগজের হেডলাইন তৈরি করবে।…’
বিধাতা বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমার আবেদন আমি মঞ্জুর করলাম। তবে আমাকে একটু সময় দিতে হবে।’
জুতামামার ন্যায্য আবদার পূরণ করতে গিয়ে বিধাতা চিন্তায় পড়ে গেলেন—কীভাবে তাকে ইতিহাসের অংশ করা যায়। একবার ভাবলেন, আকাশ থেকে জুতাবৃষ্টি বর্ষণ করলে কেমন হয়। কিন্তু না, মানুষের যে স্বভাব, দুই দিন পরই ভুলে যাবে।
আরেকবার চিন্তা করলেন, জুতা নিয়ে একটি যুদ্ধ হলে কেমন হয়। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ নেই, কেননা এর চেয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধের ঘটনাও সময়ের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
তারপর বিধাতার ইচ্ছায় বছরের পর বছর পৃথিবীতে জুতা নিয়ে ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটলেও তেমন কোনো আলোচনা বা সমালোচনার ঝড় তুলতে পারেনি।
ইংরেজ শাসনামলে দীনবন্ধু মিত্র রচিত নীলদর্পণ যখন মঞ্চস্থ হয়, তখন ইংরেজদের অত্যাচারের মঞ্চ-অভিনয় দেখে দর্শক জুতা নিক্ষেপ করেছিল। একই ঘটনা ঘটেছিল পলাশী যুদ্ধ নিয়ে রচিত সিরাজদ্দৌলা যখন মঞ্চস্থ হয়। মীর জাফরের কার্যকলাপের অভিনয় দেখে উত্তেজিত দর্শক নিজের জুতার মায়া ত্যাগ করেছিল।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই জুতা নিয়ে অনেক গল্প, কবিতা, গান, কৌতুক ইত্যাদি রচিত হয়েছে। অসংখ্য হাস্যকর ঘটনা ঘটেছে। আমাদের এই উপমহাদেশেও জুতা নিয়ে কবিতা (যেমন—একদা ছিল না জুতা চরণ যুগলে…), গান (যেমন—মেরা জুতা হে জাপানি…), প্রবাদ-প্রবচন (যেমন—গরু মেরে জুতা দান) ইত্যাদি আরও কত কি রচিত হয়েছে, কোনো হিসাব নেই। এত কিছুর পরও জুতামামা সন্তুষ্ট হয় না। বিধাতাকে ক্ষণে ক্ষণে তাঁর দেওয়া ওয়াদার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। জুতামামার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে বিধাতা সিদ্ধান্ত নিলেন যে জুতা নিয়ে বহুল আলোচিত ইতিহাস রচনা করা হবে। এরই মধ্যে দিন, তারিখ, স্থান নির্ধারণ হয়ে গেল।
১৪ ডিসেম্বর ২০০৮, সব জল্পনা-কল্পনা ভঙ্গ করে কাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি পৃথিবীতে আলোর মুখ দেখল। ঘটনার নায়ক ইরাকি সাংবাদিক মুনতাজার আল জাইদি। অন্যদিকে ঘটনার বলি হলেন এ সময়ের সেরা কুলাঙ্গার জর্জ ডব্লিউ বুশ। কালো, চকচকে, পলিশ করা জুতা। দেখেই বোঝা গেছে, ব্র্যান্ডের জুতা। জুতা মারার ক্ষেত্রেও জাইদি সাহেবের রুচির তারিফ করতে হয়। মি. বুশ যেহেতু প্রেসিডেন্ট মানুষ, তাঁকে তো আর যেনতেন জুতা মারা যায় না!
অনেকে মনে করেছিলেন, কাহিনি বোধহয় এখানেই শেষ। কিন্তু না। আসল চমক কিছুদিন পর থেকেই। ঘটনার কয়েক দিনের মাথায় জুতার ব্র্যান্ড-মালিকানা নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে বিরোধ দেখা দিল। পরে অবশ্য প্রমাণিত হলো, জুতা দুটো তুরস্কের বাইডেন কোম্পানির তৈরি। বাইডেন কোম্পানি এই মডেলের জুতার নাম দেয় ‘বুশ মডেল’। এ মডেলের জুতা কেনার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের জুতার দোকানগুলোতে রীতিমতো ভিড় লেগে যায়। বাইডেন কোম্পানির এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, বুশকে জুতা মারার ঘটনার পর বিশ্বের নানা দেশ (এমনকি আমেরিকা) থেকে এই মডেলের জুতা তৈরির প্রচুর অগ্রিম অর্ডার জমা পড়ে, যা বিগত কয়েক বছরের মোট উত্পাদনসংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যায়। পৃথিবীর অনেক মানুষ এই মডেলের জুতা একনজর দেখে মনের সাধ পূরণ করে। তাঁদের কেউ কেউ আবার এ মডেলের জুতা সংরক্ষণ করে ভবিষ্যত্ বংশধরদের দেখানোর জন্য।
মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো স্থানে ল্যান্ডমার্ক হিসেবে এই মডেলের জুতার বিশাল ভাস্কর্য তৈরি করা হয়। শুনেছি, মধ্যপ্রাচ্যের রাজপরিবারের কোনো এক ধনকুবের অনেক টাকা দিয়ে নিলামে এ জুতা দুটো কিনে নিয়েছেন।
কম্পিউটার প্রোগ্রামাররাও এ ক্ষেত্রে বসে নেই। শিশুদের আনন্দ দেওয়ার জন্য তাঁরা জুতা নিয়ে বেশ কিছু চমত্কার গেম তৈরি করেছেন। প্রতিটি গেমের টার্গেট মোটামুটি একই রকম। যদি আপনি বুশের গালে জুতা মারতে সমর্থ হন, তবেই আপনি পয়েন্ট পাবেন।
গুলিস্তানের মলম-বিক্রেতারাও কিছুদিনের জন্য মলম বিক্রি বন্ধ করে জুতা মারার কাহিনি নিয়ে পুস্তিকা ছাপিয়ে মাইকিং করে বিক্রি করেছিলেন। তাঁদের বিনিয়োগ বৃথা যায়নি। তাঁদের ক্যানভাসিংয়ের ভাষা ছিল অনেকটা এ রকম: এই বইটি পড়লে আপনি জানতে পারবেন—
কে বুশকে জুতা মেরেছিল,
কয়টি জুতা মেরেছিল।
কত নম্বর জুতা মেরেছিল।
এই বইটি পড়লে আপনি আরও জানতে পারবেন…। আমরা যদি এ দিনটায় জুতা ছোড়ার বর্ষপূর্তি উত্সব পালন করি, তাহলে কেমন হয়? এ বছর তো পারা গেল না, সামনের বছর থেকে এ উত্সব পালন করলে কেমন হয়? এ উপলক্ষে মানুষ বুশের ছবিতে জুতা মেরে আনন্দ-উল্লাস করবে, শোভাযাত্রা হবে, সভা-সেমিনার-সিম্পোজিয়াম হবে। জুতামারাবিষয়ক বিশেষ মুভি বা ডকুমেন্টারি দেখানো হবে। জুতার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত্ নিয়ে বিশেষ টক শোসহ সম্ভাব্য সবকিছুরই আয়োজন করা হবে। এ কথা শুনে অনেকেই পাগল ভাবতে পারেন। তবে সেদিন বেশি দূরে নয়!
চৌধুরী শ্যামল
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২৬, ২০০৯
Leave a Reply