আখ্যান বা উপন্যাসের মৌল প্রবণতা এই যে, সে পুরোদস্তুর একটি গল্প বলতে চায়। কোনো জনগোষ্ঠী কিংবা জনপদের মানুষের টুকরো ছবি ও কথাভাষ্য পরম্পরায় সে প্রকাশ করতে চায় একান্ত নিজস্ব অবয়ব। আর এই প্রক্রিয়ার মধ্যে লেখকের অভিপ্রায় এবং মনোভঙ্গিও গোপন রাখবার জো থাকে না। কথার শাসনে একটি জনপদ ও জনমানুষের সচলচিত্র আঁকতে গিয়ে লেখককে প্রথমত সেই জনপদের আত্মা ও নিঃশ্বাসটি স্পর্শ করতে হয়। তবেই না জমে ওঠে উপন্যাসের জমিজিরাতে লিখিত গল্পের আসর। কথাসাহিত্যিক হরিপদ দত্ত প্রণীত উপন্যাস-পুস্তক শীতলক্ষ্যা নদীবিধৌত এক জনপদের জীবনছবি। তবে এখানে শীতলক্ষ্যা-তীরবর্তী মানুষের জীবনভাষ্যের ঠিকুজি মিললেও সামগ্রিক জনপদের আত্মা ও নিঃশ্বাসের তালাশ হয়তো কদাচিত্ পাওয়া যাবে। কারণ, পুরো উপন্যাসের বয়ান কাঠামোর মধ্যে লেখক হরিপদ দত্তের উপস্থিতি এতটাই প্রবল যে, অনেক ক্ষেত্রে জনপদের দিনলিপির বাইরে লেখকের অভিপ্রায়টিই মুখ্য হয়ে ওঠে। আবার এ কথাও বলা যায়, শীতলক্ষ্যা নামাঙ্কিত উপন্যাসটির বিষয়-প্রেক্ষাপট হরিপদ দত্তের মনোভূমের এক নস্টালজিক অভিঘাত। লেখকের ভাষ্যে—‘শীতলক্ষ্যা আমার জন্ম ঠিকানা। জন্ম-ভিটা আর জন্ম-নদীকে চির জীবনের মতো হারিয়েছি। ওরা আমার পর হয়ে গেছে। হারানো সেই জন্ম-নদী নিয়েই আমার এই উপন্যাস।’ ফলে উপন্যাসের সঙ্গে লেখকের অতি সক্রিয় বোঝাপড়া হেতু কখনো কখনো এই রচনার স্বাভাবিক চলনের সঙ্গে রচয়িতার অভিপ্রায় ও আকাঙ্ক্ষা যথাযথ নৈর্ব্যক্তিকতাসহ মিশ খায়নি ঠিকঠাক। বলা যায়, উপন্যাসটি যে জনপদের পটভূমিকায় বিস্তৃতি পেয়েছে, তা নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী তথা শীতলক্ষ্যা পারের মানুষের উত্থান-পতন ও স্বপ্ন-উদ্দীপনার গল্প।
কালো বরণ শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গে মিল রেখে যে মেয়েটির নাম—সেই শীতলক্ষ্যা নাম্নী মেয়েটি এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। শীতলক্ষ্যার পিতা পূর্ণচরণ, জ্ঞাতি-সম্পর্কীয় ভাই পরমেশ এবং নদীপারের অগণন মানুষের লড়াই ও লড়াইজাত যাপনভঙ্গি আলোচ্য উপন্যাসের উপজীব্য। তত্সঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প সভ্যতার আগ্রাসনে অসহায় প্রকৃতি এবং প্রকৃতির বুক চিরে বেড়ে ওঠা মানুষের সকরুণ চিত্রপট মূর্ত হয়ে উঠেছে এই উপন্যাসে। কখনো মনে হয়, মানুষ ছাড়াও এখানে শীতলক্ষ্যা নদী তার ইতিহাস ও বিস্তৃতিসহ নিজেই একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে। আর মানুষগুলো যেন বা আবর্তিত হচ্ছে ওই চরিত্রকে ঘিরে। মোদ্দা কথা, উপন্যাসের আখ্যান নির্মাণের ক্ষেত্রে লেখক সচেতনভাবেই ধ্রুপদী প্রকরণ কিংবা আবহ-ব্যঞ্জনার সমীপে আশ্রয় খুঁজেছেন মনে হয়। যে কারণে দেখতে পাই, নাম চরিত্র শীতলক্ষ্যা, নদীর সমান্তরালে পত্র-পল্লবিত হতে হতে দিনে মিথ হয়ে উঠছে। বিশেষত শীতলক্ষ্যা নামের মেয়েটির জন্ম ও বিকাশের বিভিন্ন পর্বে—যখন সে একই গোত্রের রক্ত-সম্বন্ধীয় পরমেশের প্রতি প্রণয়াসক্ত হয় এবং সামাজিক বিধি-নিষেধাজ্ঞার কারণে আত্মসংবরণ করে, তখনই শীতলক্ষ্যা নিরুদ্দিষ্ট হয়। এ ক্ষেত্রে শীতলক্ষ্যা সুপারভাইজার যুবকের হাতে নিহত হয় নাকি ‘জলকন্যা’র মতো হারিয়ে যায়, সে বিষয়ে হরিপদ দত্ত স্পষ্ট সুরাহায় আসেননি। তবে উপন্যাসের উপান্তে পৌঁছে শীতলক্ষ্যার কঙ্কাল যখন বালির মধ্য থেকে উদ্ধার করা হয়, তা থেকে ধারণা নেওয়া যায় যে এই মেয়েটি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে শীতলক্ষ্যাকে মিথরূপে নির্মাণে লেখকের যে আপ্রাণ প্রয়াস তা প্রায় সম্পন্ন। কেননা শীতলক্ষ্যা তখন পূর্ণচরণ অথবা পরমেশের দৃশ্যমান জগতে দেখা দিয়ে আবার অদৃশ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। এমনকি গভীর কালো জলের দহে যখন পিতা পূর্ণচরণ কন্যা শীতলক্ষ্যার কঙ্কালটি ডুবিয়ে দেয় তখন সে বলে ওঠে—‘জলকন্যা, যদি তুই হাচাই আমার মাইয়া লক্ষ্যা হইয়া থাকস তবে শীতলক্ষ্যার বেবাক পানি আগুন হইয়া জ্বইলা উঠুক।’ এরপর পরই জলের দহে অগ্নিকুণ্ডের বান ডাকে। ৬৮ মাইল দীর্ঘ অগ্নিবন্যার ভেতর দিয়ে ডিঙি বেয়ে চলে পূর্ণচরণ। বেশ বুঝতে পারা যায়, ঘটনা প্রবাহের এরূপ পরিণতি লেখকের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিরূপ। নদীবর্তী মত্স্য সভ্যতার বিলয়ের প্রেক্ষাপটে নাগরিক প্রবাহ এবং শিল্পসভ্যতা গ্রাস করছে নদী ও মানুষের আশ্রয়। লেখক আগ্রাসী শিল্প সভ্যতার ধ্বংস দেখতে আগ্রহী। ফলে আগুনের প্রলয় তাঁর ভাষায়—‘শিল্পেরই ইচ্ছাপূরণ বা পরিবেশ বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে প্রকৃতির প্রতিশোধ।’
কিন্তু ‘প্রতিশোধ’ পদ্ধতির আড়ালে লেখকের মনোবাঞ্ছাও গোপন থাকেনি, প্রকারান্তরে এই কর্মকাণ্ডটি সমগ্র উপন্যাসের সাপেক্ষে লেখকের অভিপ্রায়কেই মূর্ত করে তুলেছে। উপন্যাসটিও ধাবিত হয়েছে এক আবেগাক্রান্ত পরিণতির দিকে। দেখা যাবে, প্রথম থেকে উপন্যাসের নির্মাণ কৌশল পরম্পরায় শীতলক্ষ্যা চরিত্র এবং নদীবিধৌত মানুষগুলোর যে চরিত্র-বৈশিষ্ট্য উদ্ভাসিত হয়, এই আবেগমূলক পরিণতির কাছে সমর্পিত হতে গিয়ে প্রকৃতপক্ষে তা সমগ্র উপন্যাস কাঠামোকেই দুর্বল করে তুলেছে। শীতলক্ষ্যা চরিত্রকে মিথের মহিমায় প্রতিপন্ন করার যে প্রয়াস এবং উপন্যাসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় যে ধ্রুপদী ব্যঞ্জনা জারি রাখার প্রচেষ্টা শেষমেশ তাও অক্ষুণ্ন থাকে না এরূপ পরিণতির ফলে। এখানেই একটি নদীকেন্দ্রিক জনপদের আত্মা ও নিঃশ্বাসকে পুরো মাত্রায় স্পর্শ করতে ব্যর্থ হয় শীতলক্ষ্যা।
তার পরও শীতলক্ষ্যা পারের মানুষজনের জীবনভাষ্য রচনায় লেখক হিসেবে হরিপদ দত্তের সততার ঘাটতি আছে—এমন কথা বলা যাবে না। অন্তত নদীপ্রবণ জনপদের মানুষের জীবন অভিজ্ঞান রচনার্থে তাঁর প্রচেষ্টার কমতি নেই। শীতলক্ষ্যা শিরোনামাযুক্ত আখ্যানের কলেবরে তিনি বরং বিধৃত করেছেন নদীমাতৃক প্রান্তিক জনসম্প্রদায়ের সেই সব দুঃখ-সুখ-আনন্দ-বেদনার খেরোখাতা, যা হয়তো কোনো সংবেদনশীল পাঠকের অন্তর-জমিনকে ছুঁয়ে গেলেও যেতে পারে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ৩০, ২০১০
Leave a Reply