সুকান্ত দত্ত আজ সকালের ডাকে মামার কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছে। তিনি লিখেছেন: সুকান্ত, তোমার বিবাহ স্থির করেছি, বিজয়লক্ষ্মী কটনমিলের কর্তা বিজয় ঘোষের মেয়ে সুনন্দার সঙ্গে। মেয়েটি সুশ্রী, খুব ফরসা, বিএসসি পাস করতে পারেনি, তবে বেশ চালাক। ফটো পাঠালুম। আশা করি তোমার পছন্দ হবে। তেইশে ফাল্গুন বিবাহ। বিবাহের অন্তত দুদিন আগে তোমার আসা চাই।
সুকান্ত মামার চিঠিটা মন দিয়ে পড়ল, ফটোটাও ভালো করে দেখল। কিছুক্ষণ ভেবে সে তার রঙের বাক্স থেকে তিন-চার রকম রং নিয়ে এক টুকরো কাগজে লাগাল এবং নিজের বাঁ-হাতের কব্জির ওপর কাগজখানা রেখে বারবার দেখল তার গায়ের রঙের সঙ্গে মিল হয়েছে কিনা। তারপর আরও খানিকক্ষণ ভেবে এই চিঠি লিখল: শ্রীযুক্ত সুনন্দা ঘোষ সমীপে। আমার সঙ্গে আপনার বিবাহের সম্বন্ধ স্থির হয়েছে। মামাবাবুর চিঠিতে জানলুম আপনি খুব ফরসা। আমার রং কিন্তু খুব ময়লা। হয়তো আপনি শুনেছেন শ্যামবর্ণ, কিন্তু তাতে অনেক রকম শেড বোঝায়। আমার গায়ের রং ঠিক কী রকম তা আপনাকে জানানো কর্তব্য মনে করি, সে জন্য এক টুকরো কাগজে রং লাগিয়ে পাঠাচ্ছি, আমার বাঁ-হাতের কব্জির ওপর পিঠের সঙ্গে মিল আছে। এ রকম গাঢ় শ্যামবর্ণ স্বামীতে যদি আপনার আপত্তি না থাকে, তবে দয়া করে একলাইন লিখবেন—আপত্তি নেই। আমার ঠিকানা লেখা খাম পাঠালুম। যদি আপত্তি থাকে তবে চিঠি লেখার দরকার নেই। পাঁচ দিনের মধ্যে আপনার উত্তর না পেলে বুঝব আপনি নারাজ। সে ক্ষেত্রে আমি মামাবাবুকে জানাব যে এই সম্বন্ধ আমার পছন্দ নয়, অন্য পাত্রী দেখা হোক। ইতি সুকান্ত।
চার দিন পরে উত্তর এল।—ডক্টর সুকান্ত দত্ত সমীপে। আপত্তি নেই। কিন্তু প্রকৃত খবর আপনি পাননি, আমার গায়ের রং আপনার চেয়ে ময়লা, কনে দেখার সময় আমাকে পেন্ট করে আপনার মামাবাবুকে ঠকানো হয়েছিল। কিন্তু আপনার মতো সত্যবাদী ভদ্রলোককে আমি ঠকাতে চাই না। আমার কাছে ছবি আঁকার রং নেই। আপনি যে নমুনা পাঠিয়েছেন সেই কাগজ থেকে এক টুকরো কেটে তার ওপর একটু ব্লু ব্ল্যাক কালি লাগিয়ে আমার হাতের রঙের সমান করে পাঠালুম।
আমার কালো রঙে আপত্তি থাকলে সম্বন্ধ বাতিল করে দেবেন। ইতি সুনন্দা।
চিঠি পেয়েই সুকান্ত উত্তর লিখল।—আপনার রং আমার চেয়ে একপোঁচ বেশি ময়লা হলেও আমার আপত্তি নেই। তবে সত্য কথা বলব। প্রথমটা মন খুঁতখুঁত করেছিল, কারণ সুন্দরী বউ একটা সম্পদ। কিন্তু পরেই মনে হলো, এ রকম ভাবা নিতান্ত মূর্খতা। রং ময়লা হলেই মানুষ কুিসত হয় না।
আমার একটা বদভ্যাস আছে, জানানো উচিত মনে করি। রোজ পনেরো-কুড়িটা সিগারেট খাই। আমার এক বউদিদি বলেন, সিগারেট-খোরদের নিঃশ্বাসে একটা বিশ্রী মুখপোড়া গন্ধ হয়, তাদের বউরা তা পছন্দ করে না, কিন্তু চক্ষুলজ্জায় কিছু বলতে পারে না। আপনার আপত্তি থাকলে জানাবেন, আমি সম্বন্ধ বাতিল করে দেব। সুকান্ত।
চার দিন পরে সুনন্দার উত্তর এল।—মুখপোড়া গন্ধে আমার আপত্তি নেই। আমি রোজ বিশ-পঁচিশ খিলি পান আর দোক্তা খাই। দাঁতের অবস্থা বুঝতেই পারছেন। যারা পান-দোক্তা খায় তাদের নিঃশ্বাসে নাকি অ্যামোনিয়ার গন্ধ থাকে। আপত্তি না থাকলে জানাবেন, নতুবা সম্বন্ধ ভেঙে দেবেন। ইতি সুনন্দা।
সুকান্ত উত্তর লিখল—আপনি যখন সিগারেটের দুর্গন্ধ সইতে রাজি আছেন তখন পান-দোক্তায়ও আমার আপত্তি নেই। তা ছাড়া আমার আর একটি ত্রুটি জানাচ্ছি। সুরঙ্গী নামে এক মেয়ের সঙ্গে আমার প্রেম হয়েছিল। সম্প্রতি সে বিয়ে করেছে। সুরঙ্গীর একটা ফটো আমার কাছে আছে, আপনার সামনেই সেটা পুড়িয়ে ফেলব। ইতি সুকান্ত।
সুনন্দার উত্তর এল।—আপনি অতি সত্যনিষ্ঠ অকপট সাধুপুরুষ। অতএব আমিও অকপটে আমার গলদ জানাচ্ছি। পবন কুমার পোস্ট গ্র্যাজুয়েটে পড়ত, তার সঙ্গে আমার প্রেম হয়েছিল। কিন্তু সে ভাদুড়ী ব্রাহ্মণ, সেকেলে গোঁড়া মা-বাপ আমাকে পুত্রবধূ করতে মোটেই রাজি হলেন না। পবন এখন ব্যাংগালোরে আছে, খুব একটা বড় পোস্ট পেয়েছে। তাকে পুরো ভুলতে পারিনি, তবে আপনার মতো মহাপ্রাণ স্বামী পেলে একেবারে ভুলে যাব তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সুকান্ত উত্তর লিখল।—সুনন্দা, তোমাকে আজ নাম ধরে সম্বোধন করছি, কারণ আমাদের দুজনের মধ্যে এখন আর কোনো লুকোচুরি রইল না, বিবাহের বাধাও কিছু নেই। সাত দিন পরেই আমাদের বিবাহ। তোমার সঙ্গে সাক্ষাত্ আলাপের আনন্দ এখনই কল্পনায় উপভোগ করছি। তোমার সুকান্ত।
কিছু দিন পরে সুনন্দার চিঠি এল।—যাহ্ ভেস্তে গেল। পবন তার পরিবারের অমতেই আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। আমার অবস্থাটা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন। ওকে হাঁকিয়ে দেওয়া আমার সাধ্য নয়, আমি পবনের সঙ্গে পালাচ্ছি। কিন্তু আপনার প্রতি আমার একটা কর্তব্য আছে, আপনার ব্যবস্থা না করে আমি যাচ্ছি না। আমার বোন নন্দা আমার চেয়ে দেড় বছরের ছোট। দেখতে আমারই মতো, তবে রং বেশ ফরসা। সেও বিএসসি ফেল। ঝকঝকে দাঁত, পান-দোক্তা খায় না, এ পর্যন্ত প্রেমেও পড়েনি। আপনার সব চিঠিই সে পড়েছে, পড়ে ভীষণ মোহিত হয়েছে, আপনাকে বিয়ে করার জন্য মুখিয়ে আছে। ডক্টর সুকান্ত, দোহাই আপনার, কোনো হাঙ্গামা বাধাবেন না, বাড়ির কাউকেও কিছু বলবেন না। প্রোগ্রাম অনুসারে বরযাত্রী নিয়ে যথাকালে আমাদের বাড়ি আসবেন, পুরুত যে মন্ত্র পড়াবে সুবোধ বালকের মতো তাই পড়বেন, আমার বাবা নন্দাকেই আপনার হাতে সম্প্রদান করবেন। তাকে পেলে নিশ্চয়ই আপনি সুখী হবেন। নন্দা খুবই চমত্কার মেয়ে। আজ বিদায়, সুযোগ পেলে আপনার সঙ্গে দেখা করে আমি ক্ষমা চাইব।—সুনন্দা।
সুনন্দার চিঠি পড়ে সুকান্ত হতভম্ব হলো, কিন্তু একটু পরেই বুঝে দেখল, সুনন্দার প্রস্তাব মন্দ নয়। গৃহিণীই যখন দরকার তখন এক পাত্রীর বদলে আর-এক পাত্রী হলে ক্ষতি কী? যথাকালে বরযাত্রীদের সঙ্গে সুকান্ত বিয়েবাড়িতে উপস্থিত হলো। সেখানে গোলযোগের কোনো লক্ষণই তার নজরে পড়ল না।
সুকান্ত দেখল, ষোলো-সতেরো বছরের একটি ছেলে নিমন্ত্রিতদের পান আর সিগারেট পরিবেশন করছে, কন্যাপক্ষের লোকে তাকে লম্বু বলে ডাকছে। তাকে ইশারা করে কাছে ডেকে সুকান্ত চুপি চুপি প্রশ্ন করল, তুমি সুনন্দার ছোট ভাই, লম্বু?
লম্বু বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।
—এদিকের খবর কী?
—খবর সব ভালোই। দিদিকে এখন সাজানো হচ্ছে, একটু পরেই তো লগ্ন।
—সুনন্দা চলে গেছে?
—বিয়ের কনে কোথায় চলে যাবে?
—তোমার আর-এক দিদি নন্দা, তার খবর কী?
—বা রে! আমার তো একটি দিদি, তার সঙ্গেই তো আপনার বিয়ে হচ্ছে।
সুকান্ত চোখ কপালে তুলে বলল, ও!
রাত বারোটার পরে বাসর ঘরে অন্য কেউ রইল না। সুকান্ত জিজ্ঞাসা করল, তুমি সুনন্দা, না নন্দা?
—দুইই। পোশাকি নাম সুনন্দা, আটপৌরে ডাক নাম নন্দা।
[সংক্ষেপিত]
পরশুরাম: লেখক। আসল নাম রাজশেখর বসু। জন্ম ১৮৮০, মৃত্যু ১৯৬০।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২১, ২০০৯
Leave a Reply