বাঙালির রসবোধ এবং সৃষ্টিশীল প্রতিভার প্রথম পরিচয় পেয়েছিলাম রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির টয়লেটে। ইয়ার্কি হচ্ছে না মোটেও। বাঙালির প্রতিভা নিয়ে ঠাট্টা করে পাঠকের গাট্টা খাওয়ার খায়েশ হয়নি আমার। বিষয়টা তাই খোলাসাই করা যাক।
ভেতরে বসে অতিজরুরি কাজটা করার সময় চোখ-কান খোলা রাখলেই বাঙালি প্রতিভার নমুনা নজরে পড়ত। যেমন এক জায়গায় লেখা: ‘হে মহাজ্ঞানী, কর্ম করিয়া ঢালিও পানি’। অতি উত্তম উপদেশ। একদম সামনে, দরজার ভেতরের পাশটায় লেখা ছিল: ‘ডানে তাকান’। যেন অতি গুরুত্বপূর্ণ কোনো সংকেত আছে ডান দিকের দেয়ালে। মহা উত্সাহ নিয়ে ডানে তাকালাম। সেখানে লেখা: ‘বামে তাকান’। রহস্য আরও ঘনীভূত। তাকালাম বাঁয়ে। সেখানেও খোলাসা হলো না কিছুই। কারণ, সেখানে লেখা: ‘ওপরে তাকান’। শার্লক হোমস থেকে শুরু করে ফেলুদা—সব উত্তেজনা ভর করল আমার ওপর। সাগ্রহে তাকালাম ওপরে, ছাদ বরাবর। সেখানেই বোঝা গেল লেখকের গুপ্তসংকেতের আসল উদ্দেশ্য: ‘এবার তাকিয়েই থাকুন’!
এই অর্থশূন্য বাক্যে চিরকালের জন্য তাকিয়ে থাকা অর্থহীন। তবে ওই টয়লেটের দেয়ালে এক চিত্রকর্মে আমি দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। মুগ্ধতা নিয়ে নয়, আসলে পিকাসোর দুর্বোধ্যতায় আঁকা সেই ছবির মাজেজা বুঝতে আমার মতো স্লো র্যামওয়ালা মানুষের সময় লাগাই স্বাভাবিক। দূর থেকে পুরো ছবিটি একনজরে তাকিয়ে লজ্জাই পেলাম। কারণ, খানিকক্ষণ আগে যেসব রেখাগুলোকে আমি আঁকাবাঁকা নদী, পাহাড়, বৃক্ষ, গ্রামের পথ ঠাওরে ছিলাম; সেসবের সমষ্টি আসলে একটা মানুষের শরীর। বলা বাহুল্য, সেই অঙ্কিত শরীরের ওপর কাপড় চড়ানোর মতো যথেষ্ট বিদ্যা কিংবা ইচ্ছা সেই শিল্পীর ছিল না।
একটু ভালো করে তাকাতেই বুঝলাম, শিল্পী আসলে একজন শরীর বিশেষজ্ঞ। কারণ, পুরো দেয়ালটাই তিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর প্রতিভা প্রকাশে। যে চিত্রকর্মের তুলনা করা যায় পিকাসোর ‘ইয়াং লেডিজ অব অ্যাভিনিয়ন’-এর সঙ্গে। পার্থক্য কেবল, মহামতি পিকাসোর রসবোধ ছিল সূক্ষ্ম, অজানা এই শিল্পীর রসবোধ স্থূল। কারণ, শরীরের সুনির্দিষ্ট কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তিনি এঁকেছেন বিশেষ যত্ন নিয়ে। ১০-১২ বছর বয়সী এক কিশোরের কাছে সেই ছিল সচিত্র শরীরবিদ্যার প্রথম পাঠ!
শুধু শরীরবিদ্যা নয়, জটিল সব সমীকরণ চর্চার নজিরও দেখেছিলাম ওই টয়লেটে। তবে গাণিতিক রাশির বদলে সেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল মানুষের নাম। না, শুধু বক্কর+বিলকিচ এই সরল সমীকরণেই শেষ হয়ে যায়নি প্রতিভার পরিচয়। এখনো একটা সমীকরণ স্পষ্ট মনে আছে:
(পার্থ+মণি)-(তোমার বাবা–আমার বাবা)= ০!
তবে একটা জিনিস তখনো বুঝতাম না। পানপাতার ভেতর দিয়ে তীর গেলে কী হয়। কারণ, অধিকাংশ টয়লেটে দেখি এই এক ছবি। বোঁটাহীন একটা পানপাতা। সেটার ভেতর ছেদ করে চলে গেছে একটা তীর। শেষে কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরে প্রশ্নটা আমার বাসার শিক্ষককে করেছিলাম। ব্যাখ্যা দেওয়ার বদলে তিনি আমাকে দিয়েছিলেন পাঁচ মণ ওজনের এক থাপড়! তখনো বুঝিনি তাঁর রাগের কারণ কী। প্রশ্নটা কি বেয়াদবির শামিল? নাকি, এত সহজ জিনিসও না বোঝার শাস্তি?
সেই প্রশ্নের উত্তর আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল আমার এক সহপাঠিনী। আমারই চোখের সামনে যখন টুকরো টুকরো করে ছিঁড়েছিল আমার প্রথম সাহিত্যকর্ম—সাত পাতার আবেগে ভরা সুদীর্ঘ প্রেমপত্র। বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠতেই বুঝে গিয়েছিলাম, পানপাতাটা আসলে বুকের বাঁ পাশে থাকা হৃদপিণ্ড। আর তীরটা সেই ছলনাময়ীদের তূণে থাকা এক অব্যর্থ মারণাস্ত্র। সংকোচে জানাই, তীরবিদ্ধ হওয়ার কিছু দিন পরে এই লেখক নিজে তাঁর প্রথম অনুকাব্যটি লিখেছিল সেই টয়লেটের দেয়ালেই।
পৃথিবীর মহত্ সব সৃষ্টিকর্মের প্রাথমিক ধারণাটি নাকি গুণীজনেরা টয়লেট থেকেই পেয়ে থাকেন। বিদেশিরা সেটি আরও ভেবেচিন্তে কাজে লাগায়। আর বাঙালিরা সদ্যলব্ধ সৃষ্টিশীলতা কাজে লাগায় সঙ্গে সঙ্গে, মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয় টয়লেটের দেয়াল। এ ক্ষেত্রে পাবলিক টয়লেটগুলো বেছে নেওয়ার কারণ, শিল্পী আসলে নিশ্চিত হতে চান, তাঁর সৃষ্টিকর্ম কেউ না কেউ উপভোগ করবে। শুধু তাই নয়, নিচে লিখে রেখে যাবে নিজের মন্তব্য। বাঙালি চিরকালই নিজের প্রতিভার প্রতি অবিচার করেছে। আর তাই গন্ডা গন্ডা নোবেল চলে যাচ্ছে বিদেশিদের দখলে।
তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই পাবলিক টয়লেটগুলোর দেয়াল কোনোভাবে নোবেল কমিটির কাছে কুরিয়ার বা যেকোনো উপায়ে পাঠাতে পারলেই কেল্লা ফতে!
রাজীব হাসান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ২১, ২০০৯
Leave a Reply