বেলাল বেগ পাক-টিভিতে কাজ করতেন। তাঁর পক্ষে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের নীতিনির্ধারকদের সান্নিধ্য পাওয়াটা যেমন সহজ, তেমনি তাদের গোপন মনোভাব সম্পর্কে কিছু আগাম ধারণা লাভ করাও সম্ভব ছিল। অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ তিনি। প্রখর বুদ্ধির জোরে তাঁর পক্ষে অপ্রখর পাকিদের অন্তর্জগত্ সার্ফিং করাটা খুব কঠিন ছিল না। তিনি বললেন, ওদের সঙ্গে কথা বলে আমি যতটা বুঝতে পেরেছি, পাকসেনারা তাদের সার্চ লাইট অপারেশনের শুরুতে নির্বিচারে বাঙালি নিধনে ব্রতী হলেও এখন কিন্তু তাদের নির্বিচার-নিধনের শিকার হবে মুখ্যত হিন্দুরা। যার প্রমাণ আপনি জিঞ্জিরায় নিজেই কিছুটা পেয়েছেন। সুতরাং দেশের বাড়িতে ফিরে গেলেও সেখানে গিয়ে খুব বেশি দিন আপনি নিরাপদে থাকতে পারবেন, এমনটি ভাববেন না। পাকসেনারা দ্রুতই মফস্বলের শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করবে। তাদের ছত্রচ্ছায়ায় হিন্দুদের বাড়িঘরে নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ হবে। ওরা দেশটাকে হিন্দুশূন্য করার চেষ্টা করবে। নির্বিচারে হিন্দু-নিধনের পাশাপাশি চলবে বেছে বেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ধরে নিধন ও নির্যাতন করার কাজ। খবর পেয়েছি, ভারতের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী অঞ্চলে শরণার্থীশিবির খোলা হয়েছে, যত দ্রুত পারেন সীমান্ত অতিক্রম করে সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিতে চেষ্টা করবেন।
পাকসেনাবাহিনীর পরবর্তী পরিকল্পনা সম্পর্কে বেলাল বেগের আহরিত ধারণাগুলো আমার নিজের আশঙ্কার সঙ্গে মিলে গেলো। স্থির করলাম, পরদিনই আমরা ঢাকা ত্যাগ করব। বেলাল বেগ আমার সঙ্গে একমত হলেন
যে, মেসে রাত না-কাটানোই ভালো। বেলাল বেগের বাসায় থাকাটাও ঠিক হবে না। তাতে আমাদের বিপদ তো কাটবেই না, বরং আমাদের মতো মুক্তিদের আশ্রয়দানের কারণে তাঁর বিপদ বাড়বে।
সন্ধ্যার পরপর আমরা যখন আমাদের মেসে প্রবেশ করছিলাম, তখন আমার এক প্রতিবেশীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি আমাকে কাছে ডেকে চুপিচুপি জানিয়েছেন যে, পাড়ার বিহারিরা মেসের আশপাশের লোকজনের কাছে আমার অবস্থান সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছিল। ওরা আশপাশের লোকজনকে প্রশ্ন করে জানতে চাইছিল, ‘হিন্দু মৌলানা কিধার গিয়া?’
কথাটা শুনে আমার খুব হাসিও পেল, আবার খুব ভয়ও পেলাম। বুঝলাম, আমাকে ‘হিন্দু মৌলানা’ বলে আমার প্রতি ঐ বিহারিরা যে সম্মান প্রদর্শন করেছে, তা শুধু আমাকে শনাক্ত করার সুবিধের জন্যই। আমার লম্বা চুল-দাঁড়ির কারণেই আমার এই উপাধিপ্রাপ্তি। দশচক্রে পড়ে আমি যে আমার দীর্ঘদিনের প্রিয় দাড়ি সম্প্রতি কেটে ফেলেছি, সেই তথ্যটি তারা জানে না। আর জানে না বলে, আজিমপুরে ফিরতে দেখেও আমাকে হয়তো ওরা চিনতে পারেনি। দাড়ি কাটার সময় আমার কষ্ট হয়েছিল। রাগ হয়েছিল দাড়ি কাটায় প্ররোচনাদানকারী আমার কবিবন্ধু আবুল হাসান, মহাদেব সাহা, রফিক আজাদ, শহীদ কাদরীদের প্রতি। ‘হিন্দু মৌলানা’ সন্ধানী বিহারিদের চোখে ধুলো দিতে পারার আনন্দে আমার সব রাগ, সব কষ্ট জল হয়ে গেল।
নেতাজি মুখে কৃত্রিম দাড়ি লাগিয়ে ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দিয়ে ভারত ছেড়ে আফগানিস্তান দিয়ে রাশিয়া হয়ে হিটলারের জার্মানিতে পালিয়েছিলেন। আর আমি আমার আসল দাড়ি কেটে, বিহারিদের চোখে ধুলো দিয়ে আমার মেসের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছি। নিজেকে একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলে আমার মনে হতে লাগল। মনে হলো, কবি তো কিছুটা নেতাও বটে।
পাকসেনাদের চাইতে স্থানীয় বিহারিদের ভয়টাই আমাকে বেশি পেয়ে বসল। ভাবলাম, ওদের হাতে ধরা পড়লে ওরা আমাকে মৌলানার সম্মান তো দেবে না, ‘মালাউন’ হয়ে মৌলানার লেবাস ধারণের অপরাধে আমাকে কচুকাটা করে তাদের গায়ের ঝাল মিটাবে। সুতরাং মেসে থাকার ঝুঁকি না নিয়ে স্থির করলাম, মেসের সামনে শাহজাদাদের বাড়িতে রাত কাটাব। ওরা শহরের বাড়ি ছেড়ে সবাই ওদের গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে চলে গেছে। বাড়িটি সম্পূর্ণ খালি। প্রতিটি ঘরেই বড় তালা ঝুলছে কিন্তু ওদের রান্নাঘরটি খোলা পড়ে আছে। আমরা শাহজাদাদের ওই রান্নাঘরে রাত্রি যাপনের সিদ্ধান্ত নিলাম।
নির্মলেন্দু গুণ: কবি।
এই লেখাটি তাঁর আত্মকথা ১৯৭১ গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১৪, ২০০৯
Leave a Reply