মোটরসাইকেল (আমি বলি বৈদ্যুতিক ঘোড়া) জিনিসটা যে অতিশয় ভয়ংকর, সে আমি বিলক্ষণ জানতাম। তবু কোন কুক্ষণে যে এই যন্ত্রযান বাগে আনার মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলাম! রাগে-দুঃখে আমার হাত-পা কামড়াতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এখন আর পিছু ফেরার উপায় নেই। অসহায় চোখে একবার পেছনে তাকাই। বাঙালি চিরকালই কৌতূহলী জাতি। এই সকালবেলাতেই নিকেতনের বালুর মাঠে অন্তত জনাদশেক লোক হাজির। ভিড়ের মধ্যে আছেন আমার প্রশিক্ষক সদ্য নোয়াখালী থেকে আগত মোহাম্মদ শাখাওয়াত উল্লাহও। আজ আমি প্রথম একা হাতে মোটরসাইকেল চালাতে যাচ্ছি। শিষ্যের এই অগ্নিপরীক্ষার ক্ষণে তাঁর দুই পাটি দাঁতের সব কটি স্বমহিমায় উন্মোচিত। উত্সুক জনতারও আগ্রহের কমতি নেই। সকালবেলায় বিনা খরচায় এই রসময় নাটক দেখার সুযোগ তারা ছাড়বে কেন? নাটক জমিয়ে তোলার জন্যই হয়তো তারা আমাকে দূর থেকে ত্বরিত মূল্যবান দিক-নির্দেশনা দেয়—‘ভাইজান, এইটা কোনো ব্যাপারই না। খালি দূরে তাকায়া থাকবেন। দেখবেন পানির মতো সোজা।’
মনে মনে প্রমাদ গুনছি। শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাওয়াটা এতকাল মাসুদ রানায় পড়েছি, ভালো বুঝিনি। এখন সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। ‘গিয়ার ফালান।’ ওস্তাদের কণ্ঠ আমার কানে যেন তপ্ত সিসার মতো ঢোকে। শোনামাত্র আমিও আর দেরি করি না। মারি তো গন্ডার, চালাই তো মোটরসাইকেল। দিলাম ফার্স্ট গিয়ার। নয়া চকচকে লাল রঙা হিরো হোন্ডাও সঙ্গে সঙ্গে তড়াক করে এক লাফ। পেছন থেকে একটা সম্মিলিত বিজয়ধ্বনি ওঠে। কিন্তু এই ক্ষুদ্র সাফল্যের আনন্দে গা ভাসানোর সময় আমার কই? আমার যে মাঠের ওপারে পৌঁছানো চাই। নাক বরাবর সামনে তাকানোর চেষ্টা করি। ওস্তাদের নির্দেশ। মাঠের ওপাশের সীমানা দেয়ালটা আমি আগেই দেখে রেখেছিলাম। কিন্তু একি! মাঠ কই? আমার চোখের সামনে কেবল উন্মুক্ত আকাশ। মোটরসাইকেল রাস্তায় চলে জানতাম। আমারটা তো মনে হচ্ছে রীতিমতো পঙ্খিরাজ। পরমুহূর্তেই খেয়াল হয়, আমার বৈদ্যুতিক ঘোড়াটি আসলে আর আমার সঙ্গে নেই। ডানা ছাড়াই আমি জাদুকর ডেভিড কপারফিল্ডের মতো দিব্যি হাওয়ায় উড়ছি। ওপরওয়ালার কি কুদরত! আমার উড্ডয়নকাল অবশ্য স্বাভাবিক নিয়মেই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সবেগে নিচে নামি।
‘ভাগ্য ভালা। বালির ওপর পইচ্চেন।’ ওস্তাদ শাখাওয়াত উল্লাহ মাঠের পাশের ময়লা ফেলার জায়গা থেকে মোটরসাইকেলটা টেনে আনতে আনতে আমাকে বলেন। হাঁটুর কাছে ছিলে যাওয়া জায়গাটা পর্যবেক্ষণ করতে করতে আমি রণে ভঙ্গ দেওয়ার উপায় খুঁজি। আগে সাইকেল চালানো শেখা দরকার। ওটা দুম করে লাফ দেবে না।
‘মোটরসাইকেল নিছেন লাফ দেওনের জইন্য। তো লাফাইত না?’ শাখাওয়াত উল্লাহ ততক্ষণে বাহনটাকে আবার সোজা করে দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন। আবার আমাকে ওটার ওপর বসানোর পাঁয়তারা করছেন কি না, কে জানে। অগ্নিপরীক্ষা এড়াতে আমি তড়িঘড়ি হাঁটা ধরি।
আলোকচিত্রী কবির পোড় খাওয়া মোটরসাইকেলচালক। জীবনের একটা বড় অংশ নাকি সে বাইকের ওপর কাটিয়েছে। একদিন চায়ের দোকানে বসে বাহাস করতে করতে আমি তাকে মনের দুঃখটা বলেই ফেলি। ‘আরে আপনারে আমি শিখাব। আসেন কালকে কলাবাগান মাঠে।’ পরদিন সকালে কবির আর আমি জায়গামতো হাজির। ‘আপনার জন্য আলাদা সিস্টেম আছে। আপনি মোটরসাইকেল চালাইবেন স্টার্ট ছাড়া।’ নয়া ওস্তাদের নয়া তরিকা শুনে তাজ্জব লাগে। আবার দিলে আশাও জাগে একটুখানি। স্টার্ট না থাকলে বাইক লাফ দেওয়ার আশঙ্কা নেই। কবির পেছন থেকে জোরে ধাক্কা দেয়। আমি ওই ধাক্কার জোরে বাইক যতটুক আগায়, ততটুকুতেই ডান-বাম করার চেষ্টা করি। তোফা ব্যবস্থা। কী দরকার আমার ওই সব জ্যামের রাস্তায় দাবড়ে বেড়ানোর? মোটামুটি আরামেই চলল দিনচারেক। কিন্তু কবিরের পেটে এমন বদমায়েশি কে জানত! ‘আজকে গাড়ি আপনি নিজে স্টার্ট দিবেন। আপনি নিজেই চালাবেন।’ একদিন সকালে সে জল্লাদের মতো মুখ করে বলে। আমি কবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করি। ব্যাটা কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছে? ওর চোখেমুখে বিন্দুমাত্র ঠাট্টা-তামাশার লেশ নেই দেখে ভেতরে ভেতরে দমে যাই। কিন্তু মুখের ভাবে সেটা প্রকাশ করি না। রাখে ওপরওয়ালা মারে কে। জয় বজরং বলি। ভাঙো দুশমনের খুলি। কবিরকে দেখিয়েই সজোরে গাড়ি স্টার্ট দিই। তারপর সেই বিপজ্জনক মুহূর্ত। গাড়ি ফার্স্ট গিয়ারে নেওয়ার পালা। গিয়ার পরিবর্তনকারক দণ্ডটিতে চাপ দেওয়ার আগে আমার পা মুহূর্তের জন্য থেমে যায়। দুই পায়ের মাঝখানে মোটরসাইকেলটা তখন গর্জন করে যাচ্ছে। খাঁচাবন্দী বাঘ যেন। দোনামনা করছি। এরই মধ্যে আবার সেই অভাবনীয় কাণ্ড। ব্রুম ব্রুম। আপনা আপনিই গর্জন করে মোটরসাইকেল সবেগে চলে গেল ঝোপের আড়ালে। আমি স্বল্পকালীন উড্ডয়নের পর আবার যথারীতি ভূমিশয্যায়। যা ব্বাবা! কোন ফাঁকে যে পা পড়ে গিয়েছিল গিয়ারে!
শেষ খবর এই—আমার মোটরসাইকেল চালনা শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে। তবে পুরোপুরি আমার ওস্তাদদ্বয়ের কল্যাণে নয়। একজন প্রতিবন্ধী মানুষকে দেখে। ভদ্রলোকের একটি হাত কবজির কাছ থেকে বাকিটা নেই। সেই কাটা হাত নিয়েই তিনি দিব্যি মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন!
একদিন অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে বন্ধু শাহাদাত্ তুহিনের ফোন। তুহিন ডাক্তার মানুষ। যত দূর জানি, সেও আমার কাছাকাছি সময়ে মোটরসাইকেল চালনা শিক্ষায় নেমেছিল। ‘আর কইয়েন না, মোটরসাইকেল চালনা শেখা যে কী হুজ্জত! ভাবতেছি ব্যালেন্স রাখার জন্য পেছনের চাক্কার সঙ্গে এক্সট্রা চাক্কা লাগামু। ওই সব ট্রেনিংফ্রেনিং আমারে দিয়া হইব না। ’ ফোনের ওপাশে ওর সরল স্বীকারোক্তি শুনে আমার হাসি এ কান ও কান হয়ে যায়। মনের আনন্দ বুকে চেপে আমি সন্তসুলভ একটা ভাব নেওয়ার চেষ্টা করি। ‘আরে আমি আছি না। শিখায়া দিব তোমারে…আসো একদিন কলাবাগান মাঠে। শিখতে দুই দিন লাগে, বুঝছ? খালি বুকে সাহস রাখবা। আর কিচ্ছু না।’
না, তুহিন সাহস করতে পারেনি। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সে একজন মেকানিক খুঁজছে। বাইকের পেছনে অতিরিক্ত দুটো চাকা লাগানোর জন্য।
ইকবাল হোসাইন চৌধুরী
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১৪, ২০০৯
Leave a Reply