কোপেনহেগেনে চলছে জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন। পিছিয়ে নেই দেশের পশুরাও। হুমকির সম্মুখীন সুন্দরবনের এই পশুরাও বহুল আলোচিত জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক এক সম্মেলনে অংশ নিয়েছে। তাদের আলোচনা তুলে ধরেছেন আদনান মুকিত
শেয়াল: এই জঙ্গল এবং এই জঙ্গলের বাইরে যে যেখানে যে অবস্থায় আমাদের এই সম্মেলন উপভোগ করছেন, তাঁদের সবাইকে জানাই সাদর সম্ভাষণ। এত দিন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শুধু আমরাই ঝুঁকির মধ্যে ছিলাম। এবার মানুষেরাও এই ঝুঁকির ভেতর পড়েছে বলে তারা সম্মেলন-টম্মেলন করে অস্থির। যা হোক, এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে। প্রথমেই শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন আমাদের সবার প্রিয় জনাব রয়েল বেঙ্গল টাইগার!
বাঁদর: অবজেকশন! পেশিশক্তির প্রভাব খাটিয়ে উনি আগে বলবেন, এটা তো হতে পারে না। চিড়িয়াখানায় সবার আগে আমাদের আই মিন বাঁদরদের খাঁচা। সে হিসেবে আগে বক্তব্য দেওয়া আমার মৌলিক অধিকার।
হরিণ: দেখুন মি. বাঁদর, এই স্বল্প পরিসরেও আপনি অনেক বাঁদরামি করছেন। দয়া করে জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে বাঁদরামি করে আর সময় নষ্ট করবেন না। যত জ্বালা সব তো আমাদের। জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘ কাকে বলে, তা আমরা বুঝি। সব সময় আমাদের দৌড়ের ওপর থাকতে হয়। মগডালে বসে চিনাবাদাম চিবিয়ে এই দুঃখ বুঝবেন না।
কুমির: হরিণ! মুখ সামলে কমেন্ট করো। আমরা এখানে বাগধারা শিখতে আসিনি। ওই মিথ্যা ষড়যন্ত্রমূলক বাগধারাটি বলে তুমি কিন্তু পরোক্ষভাবে আমাদের অপমান করছ। আমি সব সহ্য করি, কিন্তু কেউ অপমান করলে আমার ব্লাডপ্রেশার বেড়ে যায়।
শেয়াল: এখন ঝগড়া করার সময় না! আমাদের সামনে বিরাট বিপদ। তা ছাড়া জাতীয় পশু হিসেবে বাঘ সাহেবেরই তো বক্তব্য শুরু করা উচিত।
বাঘ: আমি আর কী বক্তব্য দেব? তোমরা তো অলরেডি কথার মেলট্রেন ছুটিয়ে দিয়েছ। আমি শুধু বলতে চাই, যারা মুরব্বিদের সম্মান করে না, যারা জাতীয় জিনিসকে মর্যাদা দিতে জানে না, তারা কোনো দিনও উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছাতে পারবে না। এদের জন্যই জাতি হিসেবে আমরা ব্যাকফুটে আছি।
বাঁদর: এএহ্! ক্ষমতাবানদের স্বভাবটাই এমন, চান্স পেলেই বড় বড় কথা বলে। খুব তো লেকচার দিচ্ছেন, দুর্যোগের সময় আপনি বর্ডার ক্রস করে ওপারে গিয়ে কী কী করেছেন তা জানার জন্য গুগলে সার্চ দেওয়া লাগে না। গাছের মগডাল থেকেই সব দেখেছি।
বাঘ: বাঁদর, আপনার বাঁদরামি কিন্তু দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। আমরা একটি মহত্ উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে সমবেত হয়েছি। আর আপনি একের পর এক বিতর্কিত ইস্যু তুলে মূল আলোচনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।
শেয়াল: বাঘ সাহেব অত্যন্ত খাঁটি কথা বলেছেন। বাঁদর আমাদের জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করছে। আপনারা ওর কথায় পাত্তা দেবেন না। কিছুক্ষণ লাফালাফি করে ও এমনিতেই ঝিম মেরে যাবে। আসুন, আমরা আলোচনা রিস্টার্ট করি।
খরগোশ: আমি অনেকক্ষণ ধরেই খেয়াল করছি, বাঘের প্রতি শেয়ালের বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। জনাব শেয়াল, আপনি সম্মেলন পরিচালনা করুন। কোনো বিশেষ মহলের চামচামি করার জন্য আপনাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
শেয়াল: ইয়ে মানে… আমরা আবারও মূল আলোচনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। দয়া করে আপনারা বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটটি একটু বোঝার চেষ্টা করুন। আসলে এই পুঁজিবাদী সমাজে…
কুমির: খামোশ! কোনো রকম চালাকির চেষ্টা করলে কিন্তু খবর আছে। আমি ব্যাকডেটেড কুমির নই যে, একই বাচ্চা সাতবার দেখানোর মতো করে ধোঁকা দেবে। খরগোশের কমেন্টটি আমি লাইক করলাম। শেয়ালের সমস্যাটা কী?
বাঘ: আমি আগেই বলেছিলাম, খাল কেটে এসব লো কোয়ালিটির কুমির নিয়ে এলে আলোচনা কখনোই ফলপ্রসূ হবে না। এদের কাজ হচ্ছে নিজেদের মধ্যে প্যাঁচ লাগিয়ে বসে বসে মজা দেখা। এরা জাতীয় স্বার্থ বোঝে না।
সাপ: এক্সকিউজ মি, মি. বাঘ। এতক্ষণ আলোচনায় লগইন করিনি বলে ভাববেন না, আমি পাসওয়ার্ড ভুলে গেছি। কত বড় সাহস! আমার বসার স্টাইল নিয়ে কথা বলে? আমি প্যাঁচ দিয়ে বসে থাকলে আপনার কী? আমার কান থাকলে আপনার লেজ দিয়ে চুলকিয়ে নিশ্চিন্তে শীতনিদ্রায় যেতাম।
খরগোশ: দূর, কচ্ছপটা তিন দিন আগে সম্মেলনের উদ্দেশে যাত্রা করে এখনো ল্যান্ড করতে পারেনি। ও থাকলে এসব ফালতু প্যাঁচাল না শুনে একটা প্রীতি ম্যারাথন রেস দিতে পারতাম, শরীরটাও ফিট থাকত।
বাঘ: শেয়াল, তোমাকে আমি কিঞ্চিত স্নেহ করি, কিন্তু তোমার রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করে আলোচনায় এসে এভাবে অপমানিত হতে হচ্ছে, এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারলাম না। আজ কিন্তু যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
হরিণ: দেখুন, বাঘ সাহেব, আমার দিকে এভাবে তাকাবেন না, আমার হার্টের প্রবলেম আছে। গত মাসে আমার বাইপাস হয়েছে। আর তা ছাড়া আমি কিন্তু আপনার স্বার্থবিরোধী কোনো মন্তব্য করিনি।
কুমির: হরিণ, তুমি নিশ্চিন্তে আমার পাশে এসে বসতে পার। আমি থাকতে ওই বাঘ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
শেয়াল: তা তো অবশ্যই। কুমির অত্যন্ত সুযোগসন্ধানী খেলোয়াড়। ক্ষতি যা করার সব সে একাই করতে চায়। কিন্তু সেই সুযোগ তুমি পাবে না। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে এখানেই এই সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করছি। আপনারা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান, অবস্থা খুব একটা সুবিধার না।
কুমির: শেয়াল! সম্মেলন শেষ করেও পার পাবি না। আমার হাত থেকে তোকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১৪, ২০০৯
Leave a Reply