‘কোচ দুই ধরনের। এক দল বরখাস্ত হয়েছে। আরেক দল বরখাস্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে।’ কথাটা নিশ্চয়ই এর মধ্যে কয়েক হাজার বার শুনে ফেলেছেন। শুনুন বা না-ই শুনুন, কোথাও কোনো কোচ বরখাস্ত হলে পত্রিকায় তো পড়েছেন নিশ্চয়ই?
এই আপ্তবাক্যে আমাদের দেশে সর্বশেষ সংযোজন ‘সাবেক’ কোচ এডসন সিলভা ডিডো। কিন্তু কোচরা এমন ঘন ঘন ছাঁটাই হন কেন? অন্য কোনো দলের কথা জানি না। তবে ইংল্যান্ডের নিচু সারির একটি দলের একজন পরিচালক উত্তর দিয়েছিলেন, ‘একই কোচ বেশি দিন রাখলে, তার অজুহাতগুলো সমর্থকদের মুখস্থ হয়ে যায়। হারের পক্ষে নতুন নতুন যুক্তি দেখানোর জন্য আমরা নতুন নতুন কোচ নিয়োগ দিই।’
তার মানে, কোচের কাজ শুধুই হারা! হলেও হতে পারে। হারতে হারতে একেবারে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া এক ইংলিশ কোচের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেল। কারণ, কর্মকর্তারা বলে দিয়েছেন, এবার ম্যাচ না জিতলে সোজা বের করে দেওয়া হবে এবং বেতনটেতনও পাবেন না! বেচারা কোচ দুশ্চিন্তায় নিজের ওজন কমিয়ে ফেলেছেন। এমন সময় তাঁর এক বন্ধু এসে ভালো একটা বুদ্ধি দিল, ‘তোর দলকে প্রতিদিন সকালে ১০ মাইল করে দৌড়ানোর ব্যবস্থা কর।’
কোচ তো অবাক, ‘কেন? তাতে কি আমরা ম্যাচ জিতব?’
‘আরে নাহ্। তোর পরের ম্যাচ এখনো ১০ দিন পর। প্রতিদিন ১০ মাইল করে দৌড়ালে ওরা ম্যাচের দিন ১০০ মাইল দূরে থাকবে। হারা-জেতার তো প্রশ্নই আসে না।’
সেই কোচ এই সমাধানে আস্থা রেখেছিলেন কি না, কে জানে! তবে একই অবস্থায় পড়া আরেক কোচ একটু অন্য রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ভদ্রলোক ভাবলেন, হারতে হারতে খেলোয়াড়েরা তো ক্লান্ত হয়ে গেছে। আজ ওদের সঙ্গে বরং প্রাথমিক কিছু কথা বলা যাক। অনুশীলনে এসে সব খেলোয়াড়কে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে হাতে একটা ফুটবল নিলেন, ‘এই দেখো, এটা হচ্ছে আমাদের ফুটবল। আমরা এটা খেলি, কারণ…।’
হঠাত্ এক খেলোয়াড় হাত উঁচু করে বলল, ‘কারণ, এটা আমাদের নিয়ে খেলতে পারে না।’
এমন অবস্থায় সব কোচ মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেন না। স্কটিশ লিগের একটা ফুটবল দলের কোচ মাথা গরম করে ফেলেছিলেন। বিশ দলের লিগে তার দল ঠিক ২০তম স্থানে মৌসুম শেষ করেছে। শেষ ম্যাচের পর খেলোয়াড়দের নিয়ে বসেছেন কোচ। মুখ কালো করে বললেন, ‘বিশ দলের মধ্যে ২০তম হয়েছ। তোমাদের লজ্জা করে না?’
এক খেলোয়াড় বলল, ‘না, স্যার। লজ্জা করে না। এর চেয়ে খারাপ কিছুও তো হতে পারত।’
এবার কোচ অবাক, ‘এর চেয়ে খারাপ কিছু কীভাবে হবে!’
‘লিগে দলের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারত।’
এমন খেলোয়াড়দের হাতে পড়লে খেলা তো খেলা, জীবন সম্পর্কেও বিতৃষ্ণা ধরে যাওয়ার কথা। মার্কিন ফুটবলের একটি দল ‘নিউইয়র্ক জেট’-এর সহকারী কোচ ডগ প্লাঙ্ক একবার তাই দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘আমার জীবনে যত খেলোয়াড় পেয়েছি, সবাই শতভাগ টেম্পারমেন্টাল। ওদের ৯০ ভাগই টেম্পার (উত্তেজনা) আর ১০ ভাগ ছিল মেন্টাল (উন্মাদ)।’
কোচদের অভিজ্ঞতা যে অভিন্ন, সেটা বুঝতে জার্মান এক কোচের উদ্ধৃতি মনে রাখতে পারেন, ‘কোচিংটা হলো, পারমাণবিক যুদ্ধের মতো ব্যাপার। এখানে কেউ জেতে না। কেবল কিছু মানুষ এর মধ্যে বেঁচে যায়।’
ভারতের এক ক্রিকেট কোচ নিজের কাজে তিতিবিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত বলেছিলেন, ‘কোচের কাজ হলো কর্মকর্তা, সমর্থক আর খেলোয়াড়দের সন্তুষ্ট রাখা। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো এই তিন পক্ষ তিন ধরনের মনোভাব নিয়ে বসবাস করে।’ আর তিন পক্ষের মাঝে পড়ে প্রাণ (নাকি চাকরি?) যায় বেচারা কোচের।
ও রকম এক কোচের চাকরি চলে গেছে। রেলস্টেশনে তাঁকে পাকড়াও করেছেন সাংবাদিকেরা। এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, ‘খেলোয়াড়েরা কি আপনার সঙ্গে ছিল না?’
‘না। ছিল না।’
‘কর্মকর্তারা আপনাকে সমর্থন দেননি?’
‘না। দেননি।’
‘সমর্থকেরাও আপনার পেছনে ছিল না!’
‘না, না। সমর্থকেরা আমার পেছনে
ছিল। এই তো এ রেলস্টেশন পর্যন্ত ওরা আমার পেছন পেছন ধাওয়া করে এসেছে।’
দেবব্রত মুখোপাধ্যায়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১৪, ২০০৯
Leave a Reply