আমরা হাসি কেন? এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়া খুব মুশকিল। তবে মোটামুটিভাবে বলা যেতে পারে—আমাদের হাসতেই হয়, কেননা হাসিটা হচ্ছে গাড়ির শক্-এবজর্ভারের মতো, জীবনের অমসৃণ পথে চলাটাকে যা সাহায্য করে। আর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশায় নাকি একবার শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতীতে এক সভায় হাসির কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে সর্বসম্মত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি; তো পরদিন বিশ্বভারতীর আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন ওই সভার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘হাসির কারণ বের করতে গিয়ে সকলের চোখের জল বেরিয়ে গেল।’
আর আমাদের হাসায় কারা?
এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া একেবারেই সহজ। আমাদের হাসান কমেডিয়ান্স ও হিউমারিস্টরা। কমেডিয়ান্স আর হিউমারিস্টদের মধ্যে আবার একটুখানি তফাত্ আছে; হিউমার ও উইটের মধ্যে তফাত্ যা, কমেডিয়ান ও হিউমারিস্টের মধ্যে তফাত্ তা। আর আমরা জানি, হিউমারের সম্পর্ক হূদয়ের সঙ্গে এবং উইটের সম্পর্ক মস্তিষ্কের সঙ্গে।
পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয়তার দিক থেকে অবিসংবাদিত কমেডিয়ান জুড়ি লরেল ও হার্ডি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ভূমিকাস্বরূপ উপরিউক্ত কথাগুলো আমাকে বলতেই হলো। সত্যি বলতে কি, কমেডিয়ানদের জুড়িপ্রথাটা ওঁরাই জনপ্রিয় করে তুলেছেন (তত্পূর্বে চার্লি চ্যাপলিন একা মানুষকে হাসাতেন), যে কারণে আশির দশকে বিলেতে অবস্থানকালে আমি দেখেছি, বিবিসির টিভি প্রোগ্রামে দুই রনি—রনি বার্কার ও রনি লর্বেট আর মোরকম্ব ও ওয়াইজ—হাসাতে হাসাতে পেটে খিল ধরিয়ে দিতেন।
লরেল তথা স্ট্যান লরেলের প্রকৃত নাম আর্থার স্ট্যানলি জেফারসন আর হার্ডি তথা ওলিবার হার্ডির প্রকৃত নাম নরভেল হার্ডি (Norvel Hardy)। হার্ডির অবশ্য একটা ডাকনাম ছিল। বেইব (Babe), যেটা বেবি (Baby) শব্দেরই অপভ্রংশ। তবে কমিক ফিল্মে তাঁরা একে অন্যকে ‘স্ট্যান’ ও ‘ওলি’ বলে অভিহিত করতেন। লরেলের জন্ম ইংল্যান্ডের ল্যাংকাশায়ারে আর হার্ডির জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া রাজ্যে। অথচ তাঁরা কেমন করে আমেরিকায় একত্র হয়ে জুটি বেঁধে সুনাম কুড়ালেন, সেটাই আশ্চর্যের বিষয়।
অবয়বের দিক থেকেও তাঁরা দুজনে ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন—লরেল হালকা-পাতলা, ট্যাংট্যাংগা আর হার্ডি মোটাসোটা, এক কথায় স্থূল। ভুল তথা বোকামিটা করতেন লরেলই, তবে শারীরিকভাবে সেটার শাস্তি ভোগ করতেন হার্ডি। আর তেমন সময়টায় তিনি যে কথাগুলো সচরাচর বলতেন, সেটা বিশ্বব্যাপী খ্যাতি পায়: ওয়েল, দ্যাটস অ্যানাদার ফাইল মেস ইউ আর গাটেন মি ইনটু (বেশ, তুমি আমাকে আরেকটা গ্যাঁড়াকলে ফেলে দিয়েছ)! এ রকম অবস্থায় বরাবর লরেল তাঁর শিশুসুলভ দুষ্টুমির হাসি হেসে বিশেষভাবে রপ্ত করা ভঙ্গিতে যখন হেঁটে যেতেন, তখন দর্শকদের না হেসে উপায় ছিল না।
১৯২৬ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত তাঁরা দুজনে জুটি বেঁধে শতাধিক কমিক ফিল্মে অভিনয় করেছেন। তার মধ্যে কিছু নির্বাক যুগেরও। প্রসঙ্গত, এই জুটির হাসির ফিল্মের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে ১৯৭৮ সালে ফরাসি দেশে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে। অতঃপর ওটা এতটাই অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় যে পরবর্তী সময়ে লন্ডনে অবস্থানকালে আমি গুটি কয়েক ভিডিও ক্যাসেট কিনে ফেলি। সময়ে সময়ে আমার মনকে প্রফুল্ল করতে ওগুলো ছিল মহৌষধ।
এ স্থলে দু-একটা কাহিনী উপস্থাপন করব—
লরেল ও হার্ডির ভাগে পড়েছে মাত্র এক গ্লাস শরবত, ওটাকে দুজনে ভাগ করে খেতে হবে। হার্ডি ভদ্রতা দেখিয়ে লরেলকে প্রথমে অর্ধেক পান করতে দিলে তিনি পুরোটাই সাবাড় করে ফেললেন, আর হার্ডির উষ্মার উত্তরে নেহাত নিরীহভাবে বললেন, আমি তো ভেবেছিলাম নিচের অর্ধেক আমার। বারান্তরে পুলিশের চাকরিতে প্রবিষ্ট হয়ে প্রথম দিনই তাঁরা টেলিফোনে পুলিশের বড় সাহেবের বাসায় রাতের বেলায় চোর প্রবেশ করেছে সংবাদ পেয়ে সেখানে ছুটে গিয়ে রাতের অন্ধকারে বড় সাহেবকেই চোর মনে করে তাঁর চোখ-মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে চ্যাংদোলা করে থানায় নিয়ে এসে থানাদার সাহেবের কাছে যখন প্রমোশন দাবি করছিলেন, তখন বড় সাহেবের মুখ উন্মোচিত হওয়ায় দুজনেরই চাকরি চলে গেল।
নাইট ওউলস-এ দেখা যায়, তাঁরা দুজনে গৃহস্বামীকে না জাগিয়ে গৃহে প্রবেশ করতে চান। তো ওলি স্ট্যানকে একটি খোলা জানালা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করানোর জন্য নিতম্ব ধরে ধাক্কাধাক্কি করছেন, ইত্যবসরে দুজনে তর্কাতর্কি লেগে গেলে স্ট্যান জানালা অতিক্রম করেই শার্শি ওলির ওপর ফেলে দিয়ে ওর প্রবেশপথ রুদ্ধ করে দেন। ওলি অনেক কষ্টে নিজেকে মুক্ত করে ইশারায় স্ট্যানকে বলেন আস্তে দরজা খুলে ভেতরে নিয়ে যেতে। স্ট্যান দরজা খোলেন ঠিকই, কিন্তু ওলিকে অভ্যর্থনা করতে বাইরে বেরিয়ে এলে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে বিবিধ হাস্যকর উপায়ে গৃহ-প্রবেশে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে স্ট্যান জোরে দরজার কলবেল বাজালে বাসার বাবুর্চি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ায় ওলি ততক্ষণে গৃহে প্রবেশে সমর্থ হলেও ভয় পেয়ে বাইরে ছুটে চলে আসেন।
তার মানে, এত সব কসরতের পর তাঁদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় না—অনেকটা আমাদের দেশের সেই বোকা লোকটির মতো, যে রাতের বেলায় দূরবর্তী গ্রামে যাওয়ার উদ্দেশে বাড়ির ঘাটে বাঁধা নৌকায় চড়ে কাছি না কাটায় সারা রাত নৌকা চালিয়েও পরদিন ভোরে নিজেকে আবিষ্কার করেছিল নিজের বাড়ির দোরগোড়াতেই।
তা এগুলো বলে বোঝানোর নয়, দেখে উপভোগ করার বিষয়। হিউমার তথা হাস্যরস ভালোবাসেন না, এমন মানুষ আজ অব্দি আমি পাইনি—কেউ একটু বেশি আর কেউ একটু কম ভালোবাসেন, এই যা। রস+আলোর পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে যাঁরা রস ভালোবাসেন, তাঁদের আমি অনুরোধ করব, সম্ভব হলে ইন্টারনেটে লরেল অ্যান্ড হার্ডি দেখে নিয়ে আমার বক্তব্যের যথার্থতা যাচাই করে নিন।
পরম পরিতাপের বিষয় হলো, এই দুই ক্ষণজন্মা কমেডিয়ানের হাসির কাণ্ডকারখানা প্রদর্শন করে প্রযোজক আর পরিচালকেরা লক্ষ-কোটি ডলার উপার্জন করেছেন এবং অদ্যাবধিও করছেন। অথচ তাঁরা দুজন অভাব-অনটনে জর্জরিত হয়ে মারা গেছেন। হার্ডি মারা যান ১৯৫৭ সালে, আর লরেল আট বছর পরে ১৯৬৫ সালে। লরেল তাঁর অসুস্থ শরীর নিয়ে পার্টনারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় শরিক হননি। বলেছেন, ‘বেইব বুঝবে।’ ব্যাপারটা আমাদের সেই গল্পটার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়—
জনৈক কমেডিয়ান বিষণ্নতায় ভুগতে ভুগতে পরামর্শের জন্য গেছেন একজন মানসিক রোগের চিকিত্সকের কাছে। তা চিকিত্সক তাঁকে মন চাঙা করার জন্য বললেন, ‘আপনি অমুক কমেডিয়ানের কাছে যান, তাঁর হাসির কথাবার্তা শুনে আপনার মন ভালো হয়ে যাবে।’ কমেডিয়ান বললেন, আমিই তো সেই ব্যক্তি।’
পুনশ্চ সহূদয় পাঠক! আপনি ভেবে বসবেন না যেন, আমি শেষোক্ত গল্পটা একদম বানিয়ে বলছি। বছর কয়েক আগে পত্রিকার পাতায়ই বেরিয়েছিল, মি. বিন্স খ্যাত মি. রোয়ান এটকিনসন যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন ‘ডিপ্রেশন’ হেতু মানসিক রোগের চিকিত্সককে দেখাতে।
আতাউর রহমান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৯, ২০০৯
Leave a Reply