কিংবা ‘বাঁশ’ও বলতে পারেন। বিশেষ করে যাঁরা ঢাকা শহরে বাস করেন। ১২ মাস লোকাল বাসই যাঁদের গন্তব্যে পৌঁছানোর আশ মেটায়। নয়টায় অফিসে যাওয়ার তাড়ায় যাঁরা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটেন। একে গুঁতিয়ে, ওকে ল্যাংচে, তাকে পাশ কাটিয়ে বাসে উঠতে উঠতে যাঁদের উঠে যায় নাভিশ্বাস। ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরীতে ঠাঁই পেয়ে যান কপাল (অনেকে শরীর) গুণে। অতঃপর ঘামের দুর্গন্ধ, অক্সিজেনের অভাবে হাঁসফাঁস করতে করতে বেরিয়ে যায় দীর্ঘশ্বাস। পাশের দশাসই মহিলার হিলের চাপা খেয়ে চিত্কার করে ওঠেন, ‘উরিব্বাস!’ আর ‘পকেট সাবধান’-এ চোখ পড়ামাত্র নির্দেশিত জায়গায় হাত দিয়ে দেখেন—সর্বনাশ!
ঢাকাবাসীর কাছে বাসের ভিড়ে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাত্রা মানে নরকবাস না হোক, নিদেন ‘জার্নি বাই বাঁশ’ তো বটেই।
এ লেখা বাসওয়ালাদের গালমন্দ করে নয়। কসম খেয়ে বলছি, বিশ্বাস করুন। নিন্দুকের এক চোখ সব সময় কানা হয়। ভালোটা তারা দেখবে কী করে! আমি নিন্দুক নই। কবিও নই। হলে বলতাম, ‘হে পাবলিক বাস, তুমি মোরে করেছ মহান। দানিয়াছ মোরে ঢাকাবাসী হওয়ার সম্মান।’
আমরা যারা গাঁও-গেরাম কিংবা মফস্বল শহরের অকৃপণ আলো-হাওয়ায় বেড়ে উঠেছি এবং একসময় অকৃতজ্ঞের মতো নাড়ির টান ভুলে পাকস্থলী, মানে পেটের টানে (কিংবা দায়ে) তীর্থের কাক হয়ে রাজধানী শহরে ভিড়েছি, তাদের এই শহরে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন যথাযথ প্রশিক্ষণের। সরকার বাহাদুর তো বিষয়টা ভেবে দেখল না। হাজারটা মন্ত্রণালয়ের যন্ত্রণায় এমনিতেই কাতর বলে নতুন কোনো বিভাগও খোলা হচ্ছে না এ বিষয়ে। প্রশিক্ষণের ভারটা তাই নিজ দায়িত্বে তুলে নিয়েছে মুড়ির টিন মার্কা এসব বাস। কঠোর প্রশিক্ষণ মানেই তো সহজ যুদ্ধ।
ঢাকা শহরে ছোট্ট খুপরি ভাড়া করে আপনি থাকতে শুরু করলেন। ওই গুমোট পরিবেশ মানিয়ে নেবেন কী করে শুনি? সেই শিক্ষা আপনাকে দেবে লোকাল বাস। ঘরের পাশের নর্দমার গন্ধও তো সইতে হবে, না কী? শূন্য পকেটে এত বড় শহরে ঘোরাফেরারও প্রয়োজন হতে পারে আপনার। সেই প্রশিক্ষণ পাবেন পকেট-ওস্তাদদের (‘মার’ লিখে মার খেতে চাই না) কাছ থেকে। সব জায়গায় তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। লড়াই করেই টিকে থাকতে হবে আপনাকে। সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট। প্রশিক্ষণ পেতে চান? সকাল সাতটা-আটটার দিকে যেকোনো বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে গেলেই হবে।
ধরুন, চেষ্টা-চরিত্র করে চাকরি জোগাড় হলেও বসকে বশ করতে পারছেন না। খবরদার, চাকরি ছাড়ার অলক্ষুণে কথা একদমই ভাববেন না। কচ্ছপের মতো কামড় দিয়ে ঝুলে থাকুন। ঝুলে থাকার প্রশিক্ষণ চান? সেও মিলবে। কিংবা ধরুন, সহকর্মীকে টপকে কী করে পদোন্নতি পেতে হয়, সেই কলাকৌশলের কথা। আপনি বাসের ভিড়ে দাঁড়িয়ে। দুই সিট সামনে বসা যাত্রীটি উঠি উঠি করছে। তার পাশে যে লোক, উত্তরাধিকার সূত্রবলে তারই সেখানে বসার কথা। কিন্তু বাহু (বাহু না থাকলে বুদ্ধি) বলে পাশের জনকে টপকে টপ করে দখল করুন সিট।
‘লাইফ’টা একদম পানসে হয়ে যাচ্ছে? রিয়্যাল অ্যাকশন থ্রিলারের রোমাঞ্চ পেতে উঠে পড়ুন হামেশাই অলিখিত রেসিং নামের এমন বাসগুলোর একটায়। ওঠার সময় ঈশ্বরের নাম নিতে ভুলবেন না। কে জানে, এই ওঠা একেবারে মর্ত্যলোকের মায়া কাটিয়ে পরলোকে ওঠায় পরিণত হয় কি না! জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে এসেছে যাঁদের, সাহসের অভাবে ‘কাজ’টা করে ফেলতে পারছেন না…থাক সে কথা।
ইদানীং লোকে ফেসবুক নিয়ে কী মাতামাতি করে। অথচ এই ফেসবুকের দায়িত্ব সেই কবে থেকে পালন করে আসছে পাবলিক বাসগুলো। বাসের গায়ে-সিট কভারে কত বিচিত্র সব ‘স্ট্যাটাস’। একজন হয়তো লিখেছে, ‘ভুলো না আমায়’। নিচে অন্যজনের উত্তর, ‘কেমনে ভুলি, টাকাটা তো ফেরত দিয়া গেলা না’। শুধু মন্তব্যই নয়, অনেক মোবাইল ফোন নম্বরও পাবেন। কিন্তু খবরদার, ভুল করেও সেই নম্বরগুলোয় আবার কলটল করে বসবেন না। আমার এক বন্ধু বাসে জনৈকা রাবেয়ার নম্বর পেয়ে, উত্সাহী হয়ে ফোন দিয়ে দেখে, সেটি র্যাবের নম্বর!
শুধু এসব বৈষয়িক বিষয়েই নয়, ‘জন্মিলে মরিতে হইবে’-জাতীয় দার্শনিক শিক্ষাও লাভ করতে পারেন আপনি। ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’র মতো উচ্চমার্গের দর্শনচিন্তার জন্ম দিয়েছে পাবলিক বাস। আছে ‘আগে নামতে দিন’-এর মতো নিয়মানুবর্তিতার শিক্ষা। এমনকি ‘ভাই বড় ধন, রক্তের বাঁধন; যদিও পৃথক হয় নারীর কারণ’-এর মতো সামাজিক প্রবচন থেকে শুরু করে ‘কষ্টে আছি আইজুদ্দিন’ কিংবা ‘চাচা, ঢাকা কত দূর’ জাতীয় নাগরিক আপ্তবাক্য…কী নেই?
সত্যি বলতে কি, এই লেখার আইডিয়াও তো পাবলিক বাসের ঝাঁকুনি খেয়েই!
রাজীব হাসান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৯, ২০০৯
Leave a Reply