কীর্তিনাশার কবি মোহাম্মদ রফিকের সাম্প্রতিকতম কবিতাকর্ম দোমাটির মুখ। ধুলোর সংসারে তিনি মাটির সন্ধানী। আবার বাংলার মাটি বেয়ে চলে গেছেন বাংলার জলে। এই বাংলার মেঘ ও কাদা, রূপকথা ও কিংবদন্তি মোহাম্মদ রফিকের নিজস্ব কাব্যভঙ্গি আর ভাষায় ভাস্বর।
ঈশ্বর গুপ্তের কবিতা প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র দুঃখ করে বলেছিলেন যে এ যুগে আর খাঁটি বাঙালি কবির জন্ম হয় না। ‘খাঁটি বাঙালি কবি’ বিষয়টি তর্কসাপেক্ষ কিন্তু আলোচ্য দোমাটির মুখকে একান্তই বাংলার কবিতা বলা চলে। বাংলা বলতে ভূখণ্ডগত বাস্তবতাই শুধু নয়, বরং বৃহদার্থে বাঙালির ইতিহাস, সংগ্রাম ও স্বপ্নকেও নির্দেশ করে। এমে সেজেয়ার তাঁর দেশে ফেরার খাতায় নিজ জনগোষ্ঠীর ইতিহাস, সংগ্রাম ও স্বপ্নের কাব্যভাষ্য যেভাবে গুচ্ছিত করে গেছেন দোমাটির মুখও তেমনি এক কাব্যচেষ্টা। এক পরিব্রাজন। ধ্বস্ত, ধর্ষিতা, রোদে পোড়া, বানে ভাসা, রিক্তা বাংলার দিকে অভিযাত্রা। গ্রন্থের ভূমিকা ভাগে কবির যেমন প্রস্তাবনা—‘একদিন বৃষ্টি হল,/হঠাত্ ভিজিয়ে গেল সকল শরীর রোমকূপ;/একদিন সূর্য উঠল,/মৃতবত্ স্বপ্নে আকাঙ্ক্ষায় পাখপাখালির সমস্বর;/বহুদিন বৃষ্টি কিংবা সূর্য কোনোটাই এদিকে ভিড়ল না,/বিশ্ব যেন মরুময়, জেগে রইল চাতক-তিয়াসা;/সূর্য উঠলে দিন, বৃষ্টি হলে/সমাচ্ছন্ন পৃষ্ঠাব্যাপী মাথা তোলে শাল-মহুয়ার শাখা!’
বোঝা যাচ্ছে, মরুবাস্তব পেরিয়ে কবি যেতে চান মহুয়ার দেশে। চান শ্রম ও ঘামের প্রসূন—অন্নদা স্বদেশপ্রতিমা।
দোমাটির মুখ-এর পঞ্চান্নটি কবিতাকে আমরা এক অখণ্ড কাব্য হিসেবেই পাঠ করতে পারি। কবিতাগুলো একটিই চিত্র নির্মাণ করে। চারদিকে পাশাখেলা। খেঁকশিয়ালের বাসা। দ্রৌপদী বিবস্ত্রা। ‘মায়ের দেশে পায়ে-পায়ে মাতৃহন্তারক’। এই কালবেলায় কবি আর কী কাব্য শোনাতে পারেন? কবি এখন আশ্রয় নেন পুরাণের। বিষ্ণু দে বাংলা পুরাণের পাশাপাশি গ্রিক পুরাণে আগ্রহী হলেও মোহাম্মদ রফিকের পুরাণ ব্যবহারে বাংলা একচ্ছত্র। এখানে সদলবলে ভিড় করে বেহুলা, লখিন্দর, মত্স্যগন্ধা, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন, দ্রৌপদী, পরশের, ডালিমকুমার, পারুল কিংবা সাতভাই চম্পা। দোমাটির মুখ-এ পুরাণচর্যার বদলে ঘটে পুরাণের পুনর্জন্ম। মহুয়া আর বেহুলার সংলাপের আড়ালে ভেসে ওঠে রক্তভেজা স্বদেশমাতার শতচ্ছিন্ন শাড়ি—‘দুজনের শাড়ি বেয়ে ভিজে উঠছে বাংলাদেশ/তুই না ভাসালি ভেলা, তারপর কী যে হলো,/ আর তুই ঝুলে রইলি বিষলক্ষা ছুরির ডগায়;’ (‘মহুয়া, বেহুলা’)
বিষলক্ষা ছুরির ডগায় লটকে থাকা করুণ বাংলা এই গ্রন্থের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় কান্তিমান। ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দেব মেপে’র মতো কোনো কোনো লোকছড়াও অবলীলায় ঢুকে পড়ে দোমাটির মুখ-এ। প্রেমের কবিতারও দেখা মেলে। এই প্রেমের বিশিষ্টতা ‘তুমি, আমি’র প্রচণ্ড বৃত্তভেদিতায়। ‘তুমি আমি’ শিরোনামের একটি কবিতাতেই বিষয়টি স্পষ্টতা পায়। সেখানে সব নিখাদ ধৈবত পৌঁছে গেছে একই আদিনাদে। শরীরী সংরাগের আদলে জন্ম-মৃত্যু—জন্মান্তরের মহাবৈশ্বিক খেলার বর্ণনা ঘটে।
এই কবির দয়িতা ব্যক্তি কবির চেয়ে বেশি মুক্তিদাত্রী গোটা চরাচরের—‘শুধুই তোমাতে মরে গিয়ে ছাড়া পায় অবিমিশ্র/ঝড়-বৃষ্টি, বাজে-বজ্রে, সমুদ্র-পাহাড়, লতাপাতা,/নীলিম-ধরণী, জল, ধ্যান-জ্ঞান, গর্ভস্থ যন্ত্রণা!’ (‘শুধু তোমাতেই’)
মৃত্যুর কথা ফিরে ফিরে আসে দোমাটির মুখ-এ। এ এক ভয়াবহ অভিজ্ঞান। ব্যক্তি থেকে বৃহত্তর ব্যাধি পর্যন্ত ব্যাপ্ত মৃত্যুর মিছিল। তবে অপচয়িত জন্ম দেখতে দেখতে শ্রান্ত কবি এখন মৃত্যুর ভেতরে খোঁজেন নববসন্ত। মৃত্যুর মধ্যে বেঁচে থাকার ঘোষণাতেই আছে নিরন্তর জন্মের সংকেত। আমরা, পাঠকেরা রক্ত আর অশ্রুর পাহাড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতে দেখি হাড়-কঙ্কালের খাঁজে ফুটে আছে ‘এক ফুলকি অগ্নি’। এ অগ্নি ভস্মের নয়। উজ্জীবনের—‘জন্মের ওপারে আছে অগ্নি,/নিভাও, নিভিয়ে দাও তুমি;/মৃত্যুর ওপারে আছে শ্বাস,/জাগাও, জাগিয়ে তোলো দেখি!’ (‘দ্বিতীয় মৃত্যুগাথা’)
কে জাগাবে এই রুদ্ধশ্বাস? হয়তো কবি। প্রথম কবিতাতেই তো দেখি—‘সেই থেকে জন্ম শুরু নিরুদ্ধ কবির,/মুখ থুবড়ে পড়ে আছে লোকালয়হীন লোকভুঁয়ে!’ (‘মায়া ও কায়া’)
মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জ্ঞাপন যতটা সহজ ততটাই কঠিন মুক্তি। মোহাম্মদ রফিক কোনো ফাঁপা আশার গল্প শোনান না। তিনি নিরুদ্ধ বাস্তবের মুখচ্ছদ অঙ্কন করে যান শুধু। এর রেখা রঙের ইতিউতিতে হয়তো কোনো দিশার সংকেত আছে।
কবিতায় মোহাম্মদ রফিক পরোক্ষতা-অভিসারী। দোমাটির মুখ-এও এমনটিই দ্রষ্টব্য। তবে কখনো বা ‘আমার এ গান ছেড়েছে তার সকল অলংকার’-এর মতো দোমাটির মুখ ভেঙে দেয় সমস্ত কাব্যিক প্রসাধন—‘বাংলার কবিরা স্বপ্ন দেখেনি কখনো,/স্মৃতিকাতরতা ভর করেছিল সর্বক্ষণ,/ বর্তমান এমন হিংসুটে মিথ্যাচারী;’ (‘শোকতীর্থে পুনর্বার’)
কবি জানেন, মানুষের স্বপ্নহীন অস্তিত্বের কোনো তাত্পর্য নেই। কবি তাই সেই কুটিল পক্ষকে শনাক্ত করেন, যা মহত্তর জাগরণের স্বপ্নকে স্মৃতিকাতরতার সঙ্গে গুলিয়ে কালঘুমের আয়োজন সম্পন্ন করে। মোহাম্মদ রফিকের দোমাটির মুখ একদিকে যেমন মরণভারাতুর অন্যদিকে তা মৃত্যুজয়ী স্বপ্নপ্রতিমা। কবির সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও গন্তব্য বোধহয় সেখানে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ৩০, ২০১০
Leave a Reply