তারা এখন কোরবানির হাটের মধ্যমণি। মোটরযান বা নৌকায় করে তারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াত করছে। কপালে লাল কাপড়ের টিকলি, শিঙে রঙের প্রলেপ। গলায় জরির মালা। সন্দেহ নেই, গরুর কথাই বলা হচ্ছে। ট্রাক থেকে হাটে নেমে, সেখান থেকে বাসাবাড়িতে। আদর-আপ্যায়নে কোনো ঘাটতি নেই কোথাও। সামনেই ঈদ। তাই দাম, চেহারা ইত্যাকার নানা বিষয়ে গরু নিয়ে আলোচনা এখন সবার মুখে মুখে। পত্রিকার পাতায়, টিভির পর্দায় তাদের স্বচ্ছন্দ উপস্থিতি।
গরুর দিনকাল: গরুর এখন আর কোনো খাটুনি নেই। খায়-দায়, ঘুরে বেড়ায়, শুয়ে-বসে জাবর কেটে, মাছি তাড়িয়ে দিন কাটায়। রোদবৃষ্টি মাথায় নিয়ে জোয়াল টানা নেই। ঘানি টানার কাজ থেকে মুক্তি। গরুগুলো এখন সত্যিই বেকার।
গরুর ক্লেশমুক্তি: বাস্তবিকই গরুর ক্লেশ অনেক কমে গেছে। তাদের ক্লেশমুক্ত করেছে যন্ত্র। জমি চাষ করা হচ্ছে কলের লাঙলে। মলন দেওয়া হচ্ছে যন্ত্রে। সারা দেশে রাস্তাঘাটেরও প্রভূত উন্নতি হয়েছে, অস্বীকার করার জো নেই। কাদাপানিতে কদাকার গ্রামের মেঠোপথের চেহারা বদলে গেছে। পিচঢালা মসৃণ পাকা সড়ক চলে গেছে অনেক গ্রামের প্রান্তসীমায়। ওই পথে ভটভট করে চলছে ‘নছিমন-করিমন’। সাঁইসাঁই করে ছুটছে রিকশাভ্যান। অথচ এককালে গরু বেচারাদের কত না মেহনত করতে হয়েছে খানাখন্দে ভরা কাদামাটির পথে মালাবোঝাই গাড়ি টানতে!
দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে: গরু গৃহপালিত চতুষ্পদ প্রাণী—এ পর্যন্ত ঠিক আছে। এর পরে যদি লেখা হয় সে গাড়ি টানে, হালচাষ করে, তাহলে এখন অবাস্তব তথ্য দেওয়ার দোষে গরুর রচনায় গোল্লা পাওয়ার আশঙ্কা ষোলোআনা। অবস্থা বদলেছে, তাই আধুনিক কালে গরুর রচনা লিখতে গেলে দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে হবে। ‘গরুর মতো খাটতে খাটতে জীবন বরবাদ হয়ে গেল’ বা ‘সারা জীবন কলুর বলদের মতো শুধু সংসারের ঘানিই টেনে গেলাম’—এমন আক্ষেপ যাদের, তাদেরও নতুন উপমা খুঁজতে হবে।
গরু কেন গরু: গরুর গরু না হয়ে উপায় নেই। সে দীর্ঘ সময় একটানা চলতে পারে, তাই তার নাম গরু। ‘গো’ অর্থ গতি। আবার গো-রুত মানে গরুর ধ্বনি। তার হাম্বা ডাক বহু দূর থেকে শোনা যায়, এ কারণেও চতুষ্পদটির গরু নামকরণ। এ ছাড়া আরও অনেক নামে তার পরিচিতি। গাভি, গাই, ধেনু—সবই স্ত্রীবাচক। পুরুষবাচক নামের মধ্যে আছে—ষণ্ড, ষাঁড়, দামড়া, বৃষ, বলীবর্দ, বলদ, রোমন্থক ইত্যাদি। গরুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কিছু শব্দ মানবকুলেও ব্যবহূত। যেমন—কন্যা অর্থে ‘দুহিতা’ শব্দটি এসেছে গাভি দোহন থেকে। আগে মেয়েরা গাভি দোহন করত বলে তাদের দুহিতা বলা হতো। একইভাবে এসেছে ‘গোয়ালা’ বা ‘গোপ’ শব্দটিও। ভিন্ন অর্থেও কিছু শব্দ এসেছে গরুর সম্পর্ক থেকে। যেমন—গোধূলি, গবাক্ষ, গোগ্রাস, গোধন, গোবেচারা, গবেষণা আর পঞ্চগব্য—এর তালিকা মনে না থাকলে দেখুন কী আছে তাতে—দুধ, দই, ঘি, গোময় ও গোমূত্র; হলো তো এখন পাঁচ পদ।
পুরাণের গরু: আমাদের কৃষিভিত্তিক সমাজে গরু নামের এই নিরীহ চতুষ্পদের অবদান বলতে গেলে অপরিসীম। সেই সুমের সভ্যতা থেকেই গরু তার শ্রম থেকে শুরু করে ‘অস্থি-মজ্জা-মাংস-চর্ম-মল-মূত্র’ যাবতীয় মানব-কল্যাণার্থে দান করে আসছে। প্রাচীন ভারতে গরুকে সম্পদ-জ্ঞানে বলা হতো ‘গোধন’। রাজামহাশয়রাও গরু পুষতেন। এমনকি এক রাজা অন্য রাজার গরু লুট করতে কুণ্ঠিত হতেন না। মহাভারতে আছে, দুর্যোধন বিরাট রাজার গোধন লুট করতে গিয়েছিলেন দ্রোণাচার্য ও ভীষ্মকে সঙ্গে নিয়ে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, গরু চুরির রেওয়াজ বহুকালের। গরু নিয়ে রাজসিক কর্মও কম হয়নি। ‘স্টারসার্চ’ বা ‘ট্যালেন্ট হান্টিং’কে যদি কেউ ভেবে থাকেন হাল আমলের উদ্ভাবন, তাহলে মহা ভুল করবেন। সীতার পিতা ‘জনক রাজা’র কথাই ধরুন। কে শ্রেষ্ঠ ‘ব্রহ্মর্ষি’, এ নিয়ে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন তিনি। ঋষি যাজ্ঞবল্কের সামনে প্রতিযোগীরা উড়ে গেলেন শুকনো পাতার মতো। ঋষিপ্রবর শ্রেষ্ঠ খেতাব তো পেলেনই, পুরস্কার হিসেবে পেলেন সোনা দিয়ে শিং বাঁধানো সহস্র গোধন। কালিদাসের মেঘদূত-এর সেই যে চর্মন্বতী নদীটির কথা আছে, কেমন করে সেই নদীর সৃষ্টি? মহাভারতের কাহিনী হলো, রাজা রন্তিদেবের রান্নাঘরে প্রতিদিন দুই হাজার গরুর মাংস রান্না করা হতো অতিথি আপ্যায়নের জন্য। আর গরুর চামড়াগুলো যেখানে ঝুলিয়ে রাখা হতো, সেখান থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় চুইয়ে পড়া রক্তরস থেকে সৃষ্টি হয়েছিল একটি নদী। এই নদীটিই হলো চর্মন্বতী, বর্তমানে যাকে ডাকা হয় ‘চম্বল’ নামে।
গোবচন: কোনো কিছু হারিয়ে গেলে আমরা তো ‘গরুখোঁজা’ করিই, তবে ‘গরু মেরে জুতো দান’ করতে এলে মেজাজটা বিগড়ে যেতেই পারে। গরু নিয়ে এমন আরও মোক্ষম প্রবচন, প্রবাদ, আপ্তবাক্য চালু আছে আমাদের বাগ্বিধিতে। একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক—‘কাজির গরু খাতায় আছে গোয়ালে নেই’, ‘এক গোয়ালের গরু’, ‘গরু জরু ধান রাখ বিদ্যমান’, ‘ধর্মের ষাঁড়’, ‘কানাগরু বামুনকে দান’, ‘ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়’, আর ‘দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো’—এ কথা কে না জানে। আর কেউ যদি অহেতুক শাপশাপান্ত করতে চান, তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে এটুকু বলাই যথেষ্ট হবে, ‘শকুনের শাপে গরু মরে না’।
নানান বরন গাভি রে ভাই…
চিরাচরিত কাজকর্ম থেকে নিষ্কৃতি পেলেও গরুর কদর মোটেই কমেনি। তার দুধ থেকে গোবর—সবই মূল্যবান আমাদের কাছে। শরত্বাবু মহেষের প্রতি গফুরের ভালোবাসার যে কাহিনী কালজয়ী করে রেখে গেছেন, বাংলার কৃষকের কাছে তার গরুটি এখনো তেমনি প্রিয়। আর কোরবানির হাটে যে গরুই মধ্যমণি, সে কথা তো আগেই বলা হয়েছে।
অনেক রকমের গরুই এখন পোষা হয় আমাদের দেশে। এর মধ্যে আছে সিন্ধি, সাহিওয়াল, হলস্টোন, হরিয়ানা, লোলা, অমৃতমহল, লালসিন্ধি, মুলতানি, মন্টগোমারি, ফ্রিসিয়ানা, থরপর্কার, জার্সি, গির, কাথিয়াবারি, কাঙ্করেজ, আয়ারশায়ার ইত্যাদি। গরুর জাত যাই হোক, দুধ কিন্তু সবার একই রকম। জাতিভেদের অসারতার কথা বলতে গিয়ে গরুর তুলনা দিয়ে সে কথাটিই বলেছিলেন লালন সাঁই—‘নানান বরন গাভি রে ভাই একই বরন দুধ/ জগত্ ভরমিয়া দেখলাম সব একই মায়ের পুত…।’ গরু আর মানুষ বহুকাল থেকেই এভাবে মিলেমিশে আছে একত্রে, ভবিষ্যতেও এই বন্ধন ছিন্ন হবে এমনটা মনে হয় না।
আমাদের দেশে গৃহপালিত পশুর মধ্যে গরু যেমন সংখ্যায় বেশি তেমনি গরুর প্রতি মমত্ববোধও প্রগাঢ়। ধর্মীয় বিধানে নিজের লালিত-পালিত প্রিয় পশুটিকে কোবরানি করার উপরেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বেশি। এ কারণেও গরু কোরবানি করতে আগ্রহী হয়ে থাকেন সকলে।
আশীষ-উর-রহমান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২৫, ২০০৯
Leave a Reply