আমি তখন পলাশীতে থাকি। সুদূর তেজগাঁওয়ে অবস্থিত একটি দৈনিক পত্রিকা অফিসে কাজ করি। দুপুরের দিকে অফিসের উদ্দেশে রওনা হই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আজিমপুরের চার রাস্তার মোড়ে গিয়ে কখনো বাসের জন্য দাঁড়াই, পকেটে টাকার জোর থাকলে মাঝেমধ্যে বেবিট্যাক্সির সঙ্গেও দরকষাকষি করি। রিকশা এত দূর যেতে চায় না। সিএনজি তখনো চালু হয়নি।
পথ চলতে গিয়ে দেয়ালের লিখন পড়া আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। ইডেন কলেজের দেয়ালে বেশ মোটা-তাজা হরফে, আলকাতরা দিয়ে লেখা দুটো হুঁশিয়ারি-বাক্য আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিশ্বাস করি, আমার মতো অনেক পথচারীরই তা চোখে পড়ে থাকবে। পড়ারই কথা। বেশ কিছুদিন ধরে আমি দেয়ালের ওই লেখাটা দেখছিলাম। লেখাটা হচ্ছে এ রকম:
১. আমরা সবাই—অমুক সেনা, ভয় করি না বুলেট-বোমা।
২. অমুক ভাইয়ের কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে।
প্রথম ঘোষণাটি নিয়ে আমার খুব একটা মাথাব্যথার কারণ ছিল না। বুলেট-বোমার ভয় থেকে মুক্ত মানুষের সংখ্যা আমাদের দেশে যত বাড়ে ততই ভালো। এটাকে আমি খুশি হওয়ার মতো একটা ভালো সংবাদ বলেই মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু অমুক ভাইয়ের পক্ষ থেকে প্রচারিত দ্বিতীয় সদম্ভ ঘোষণাটি সম্পর্কে নির্বিকার বা উদাসীন থাকাটা আমার পক্ষে কিছুদিন সম্ভব হলেও, শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। যে নেতার নামে দেয়ালে চিকা মারা হয়েছিল, তাঁকে আমি চিনতাম না। তাঁর নাম কখনো কাগজে পড়েছি বলে মনে পড়ে না। তিনি কোন দল করেন, চিকাতে সে তথ্যও পরিবেশিত হয়নি। আন্দাজ করে নিলাম, তিনি নিশ্চয়ই আজিমপুর-লালবাগ এলাকার কোনো নবীন তুর্কি নেতা হবেন, যিনি দুর্ধর্ষ ক্যাডার (‘ভয় করি না বুলেট-বোমা’ স্মর্তব্য) ভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠনে বিশ্বাসী।
ওই নির্ভয়চিত্তসম্পন্ন অমুক সেনাদের সম্পর্কে জানার কৌতূহল ক্রমে ক্রমে তীব্র আকার ধারণ করলে আমি একদিন আজিমপুরের মোড়ে টহলরত একদল পুলিশের কাছে যাই। পুলিশকে সমীহ করে দূরে দাঁড়িয়ে থাকলে পুলিশ সাধারণত খুশি হয়। নির্ভয়ে তাঁদের কাছে গেলে তাঁরা আগন্তুকের সাহস দেখে কিছুটা হলেও বিরক্তি প্রকাশ করেন। সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকান। আমার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হলো না। আমি পুলিশকে বললাম, ‘আচ্ছা ভাইজান, ইডেনের দেয়ালে এই যে নেতার নামে চিকা দেখছি, উনার সম্পর্কে আপনি কি আমাকে কিছু ধারণা দিতে পারেন?’
আমার কথা শুনে পুলিশ ভদ্রলোক ইডেনের দেয়ালের দিকে চোখ ফেরালেন। পড়লেন। তারপর খুব বিরক্ত হয়ে তাঁর সঙ্গী অন্য একজন সহকর্মীকে বললেন, ‘কিয়েরে, ওই হালারে চিনস নি?’
দ্বিতীয় পুলিশও দেয়ালের চিকা পাঠ করলেন। তারপর অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে আমাকে বললেন, ‘যান তো ভাই।’
আমি বললাম, ‘দেখেন ভাই, আমি বাসায় তালা দিয়ে বেরুইছি। এখন ধরেন খোদা না করুন, হঠাত্ ওই নেতার যদি কিছু-একটা হয়ে যায়, আর নেতার সৈনিকেরা যদি আজিমপুর-লালবাগের ঘরে ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়—তাহলে আমার ঘর, ঘরের সব জিনিসপত্র তো পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।’
‘আপনে কী করেন?’
‘আমি? আমি ছোটখাটো একজন সাংবাদিক।’
সাংবাদিক শুনে পুলিশ আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘সাম্বাদেক অইয়া আপনে যদি এই হালারে না চিনুইন, তো আমরা কেমনে চিনুম? বুঝুইন না, হালায় একটা ভুয়া।’
আমি দেখলাম কথাটার মধ্যে ওজন আছে। বললাম, ধন্যবাদ।
নির্মলেন্দু গুণ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২৩, ২০০৯
Leave a Reply