একসময় কাবুল শহরে দিনকাল খারাপ ছিল না। নানা ধান্ধায় এখানকার বসবাসকে সরসই বলা যেতে পারে। তবে হালফিল সোয়াইন ফ্লুর উত্পাত শুরু হতে জ্বরজারিতে তনু-মন থেকে যেন কষ বহির্গত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করি, খানিক কায়ক্লেশে ওখানে এসে চেয়ারে বসে অ্যাসপিরিন খেয়ে একটু ঝিমানোর উদ্যোগ নিয়েছি, ঠিক তখনই দুয়ারের স্বচ্ছ কাচ দিয়ে রবার্ট রাইসকে এদিকে আসতে দেখি। রবার্ট সাহেব সপ্তা কয়েক হলো ইরাকে অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে আফগানিস্তানে এসে হাজির হয়েছেন। তিনি র্যাঙ্কের দিক থেকে আমার ওপরওয়ালা। তাঁর ধরাকে সরা জ্ঞান করার একটি প্রবণতা আছে। তার ওপর তিনি চুলদাড়িতে ডাই মেখে তা কমলালেবু বর্ণে রঞ্জিত করেছেন। দারি ও উর্দু ভাষায় কমলাকে নারেঞ্জ বলা হয়। আমার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যারা পাকিস্তানের শরণার্থী শিবিরে উর্দু বলতে বলতে বেড়ে উঠেছে, তারা ইতিমধ্যে তাঁকে পেছন থেকে ‘বালে নারেঞ্জ’ বলতে শুরু করেছে। সাহেব লবজটিকে বিশেষণ ভেবে খানিক আত্মহারা হয়ে আছেন।
রাইস সাহেব কাগজের সার্জিক্যাল মাস্ক পরে আমার কামরায় এসে ঢোকেন। আলামত স্পষ্ট, সোয়াইন ফ্লু তাঁরও নাগাল পেয়েছে। তিনি আমার হাতে আরেকটি মাস্ক দিয়ে তা পরতে বলেন। আমাদের যেহেতু দুজনেরই সোয়াইন ফ্লু হয়েছে, এ অবস্থায় আলিঙ্গন করলেও ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই, তার পরও সাহেব বলে কথা, আমি আখেরে উপকার হতে পারে ভেবে কর্তাভজা হওয়ার কোশিশ করি। মাস্ক মুখে দিয়ে আমরা মুখোমুখি হই। রাইস সাহেব জানতে চান, সোয়াইন ফ্লু হলে আফগানরা কী করে? সোয়াইন শব্দের অর্থ হচ্ছে শূকর, দারি ভাষায় এ জানোয়ার খিঞ্জির বলে পরিচিত, এবং তা উচ্চারণ করলে দিন চল্লিশেক মুখ নাপাক থাকে বলে পরহেজগার আফগানরা এ রোগকে ফুলুয়ে-দুম্বা বলতে শুরু করেছে। সাহেব বার কয়েক মুখখানা বেজায় রকমের তুম্বা করে উচ্চারণ করেন, দুম্বা দুম্বা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করে তালাশ পাওয়া যায় যে, ফ্যাকাল্টির পাগড়িওয়ালা মুরব্বি এক চাপরাশি জ্যোতিষ শাস্ত্রীয় গণনার মাধ্যমে যাদের ফুলুয়ে-দুম্বা হয়েছে, তাদের যথাস্থানে সমুচিত চিকিত্সার জন্য পাঠাচ্ছেন। এ বাবদ তিনি নজরানা নিচ্ছেন অতি স্বল্প। আমি তত্ক্ষণাত্ তাঁকে এত্তেলা দিই। একটু পর তিনি আমার কামরায় এসে সাহেবের চুলদাড়ির নরেঞ্জি রং দেখে রীতিমতো ঘাবড়ে যান। তাঁর ধারণা, ফুলুয়ে-দুম্বার সাথে সাথে হয়তো সাহেবের গর্দানে জিনেরও আছর হয়েছে। মুরব্বি আয়াতুল কুরসি পড়ে সাহেবকে ফুঁক দিতে গেলে সাহেব ধড়মড় করে যেন ঘুম থেকে জেগে উঠে জানতে চান—আফগানরা ফুলুয়ে-দুম্বার জন্য হাসপাতালে যাচ্ছে না কেন? বৃদ্ধ পশতু ভাষায় জবাব দিলে আমি তার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারি না। সাহেব আমাকে তর্জমা করার হুকুম দেন। আমি চাকরি রক্ষার্থে বলি, সুইসাইড বম্বাররা হাসপাতাল আক্রমণের হুমকি দিয়েছে। তিনি বেজায় আতান্তরে পড়ে দাড়ি চুলকে আবার বলেন, ‘ওরা হাসপাতাল আক্রমণ করবে কেন?’ আমি উপায়ান্তর না দেখে বলি, সম্ভবত আত্মঘাতী বোমারুরা বিনা চিকিত্সায় মরতে চায় না! সাহেব নোটবুক বের করে আমার মন্তব্য সিরিয়াসলি টুকে নেন।
বৃদ্ধ চাপরাশি সোলেমানি খাবনামার মতো একখানা কিতাব বের করে সাহেবকে চোখ বন্ধ করে তার একটি নকশায় অঙ্গুলি নির্দেশ করতে বলেন। তারপর নকশার হিসাবকিতাব করে আমাদের একটি দাওয়াখানায় যাওয়ার দিক নির্দেশ দেন। আমরা গাড়ি নিয়ে বের হই। পথে বিস্তর ট্রাফিক জ্যাম। গোলযোগে দাওয়াখানার দিকনির্দেশনা আমার মাথায় তালগোল পাকিয়ে দাদখানি চাল-মসুরের পাকা তাল হয়ে গেছে। কিন্তু সাহেব দাওয়াখানায় যাবেনই। মরিয়া হয়ে আমরা আন্দাজে একটি দোকানে ঢুকতে যাই। দোকানের দোরগোড়ায় দুটি তাজাতনা দুম্বা বাঁধা। দোকানি খুব সমাজত করে আমাদের আগর লোবান আতর দেখান। তারপর বের করেন কাফনের কাপড়। আমি অনেক কষ্ট করে বোঝাতে চেষ্টা করি, সাহেব যে ফুলুয়ে-দুম্বায় মারা যাবেন, এমন তো কোনো গ্যারান্টি নেই, হায়াত থাকলে বেঁচেও তো যেতে পারেন। কিন্তু দোকানি নাছোড়—আরে, এ যাত্রা বেঁচে গেলেও পরে অন্য কিছুতে তো তাঁর মওত হবে। আমি সস্তায় দিচ্ছি, কাফন কিনে নাও, সাহেব তো আর অমর নন, পরে না হয় কাজে লাগবে। আমি সাথে করে টাকা-পয়সা আনিনি—এ অজুহাত দিই; বলি, সাহেব মালদার আদমি, পরে ডলার নিয়ে এসে শুধু কাফন কেন, কফিন খাটিয়া সবই কিনে নিয়ে যাবেন, বলে কোনোক্রমে দোকান থেকে বেরিয়ে আসি। গাড়িতে উঠতে উঠতে সাহেব মন্তব্য করেন, ‘আফগানস্ আর অ্যাডভান্স থিংকার!
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২৩, ২০০৯
Leave a Reply