লিভিং রুমে ফুয়াদ ভাই ও ফুলা ভাইকে দেখে আমার চোখ যে ছানাবড়া হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। ফুয়াদ এবং ফুলা। আমার দুই ফুফুর দুই ‘ফু’! এই দুই ‘ফু’-এর একটা ‘ফু’-ই যথেষ্ট যেকোনো ধরনের অঘটন ঘটাতে!
‘আরে, আয় আয়, ডায়নামিক রাইটার’, তেল মারার ডায়নামোটা চালু করেন ফুলা ভাই। বলি, ‘কী ব্যাপার?’
‘ব্যাপার হচ্ছে’, গলা খাঁকারি দেন ফুয়াদ ভাই। ‘আমরা মিডিয়া নিয়ে ব্যবসা করব বলে ঠিক করেছি’—বলেই জিহ্বা কামড় দেন।
‘মানে—’, শুধরে দেন ফুলা ভাই। ‘মিডিয়ায় ব্যবসা করব আর কী।’
‘অনুষ্ঠান বানাবে?’
‘আরে না না—। সে তো তুই-ই বানাস।’
‘তাহলে?’
‘আমরা অভিনেতা-অভিনেত্রী বানাব, মডেল বানাব, উপস্থাপক বানাব—’, উত্তেজনায় হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে ফুলা ভাইয়ের।
‘উপস্থাপক না হতে চাইলে উপব্যবস্থাপক বানিয়ে ছেড়ে দেব’, ফুয়াদ ভাই আধাআধি দাঁড়িয়ে যান। অতঃপর ‘বেশি তেড়িবেড়ি করলে এক ধাক্কায় ব্যবস্থাপক বানিয়ে বসিয়ে দেব।’
‘আ-হ্—!’ ফুলা ভাইয়ের কমান্ডিং ভয়েসের ধাক্কায় নিজেই পড়েন ফুয়াদ ভাই। নরম সুরে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘কল্লোল। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা আমার আর ফুয়াদের পকেটকে কাপড় ছাড়া ক্যারমবোর্ডের পকেট বানিয়ে দিয়েছে, তুই তো জানিস। আর সেই মন্দার ধাক্কা তোর স্যুপের বাটিতেও পড়েছে!’
চমকে উঠি আমি। ‘মানে?’
‘মানে, আগে জগিংয়ের পর তুই তোর পছন্দের সেই গ্রিক অথবা ইতালীয় রেস্তোরাঁর স্যুপগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তি। কিন্তু ইদানীং মন্দার চোটে তুই ট্র্যাডিশনাল থাই আর চাইনিজ স্যুপে ফিরে গেছিস। তোর এই থাই এবং চাইনিজ দারিদ্র্য আমাদের যারপরনাই পীড়া দিয়েছে—! আমরা চাই তুই আবার পকেট ভারী করে থাই-চায়না ছেড়ে ইতালি-গ্রিসের দিকে দৌড় লাগা। এশিয়া ছেড়ে ইউরোপের বাটিতে চামচের ঝড় তোল।’ এদের ইউরোপিয়ান চালে আমি শর্ত সাপেক্ষে রাজি হয়ে গেলাম।
দুই.
আমাদের সিদ্ধান্ত হলো, আমি কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করব। ‘ইয়ে’, কাগজে চোখ রেখে বলেন ফুলা ভাই, ‘দু-একজন ফেস পাউডার রাখলে ভালো হতো রে—।’
‘ফেস্ পাউডার না,’ শুধরে দেই আমি, ‘ফেস ভ্যালু।’
‘রা-ই-ট’, ফুলা ভাই আটলান্টিক ওশানে নুড়ি পাথরটি খুঁজে পেলেন।
‘দু-একটা ফেস্ ভ্যালু আমাদের সঙ্গে ইন্টারভিউতে থাকলে ভালো হতো, বুঝলি? ক্লায়েন্ট ছেলেমেয়েগুলো আস্থা পেত। তুই লিমাকে আনতে পারবি না? ওর তো বেশ ভ্যালু ইদানীং!’
‘পারব না কেন?’
‘তাহলে নিয়ে আয়। আমরা পে করব। ওর রেট জানা আছে তোর? ও কি ঘণ্টা বেসিসে পেমেন্ট নেয়, নাকি শিফট বেসিসে?’ ফুলা ভাইয়ের আঙুল ক্যালকুলেটরে।
‘আমার মনে হয় ডে বেসিসে। আজকাল বেশির ভাগ অভিনয়শিল্পী তা-ই নিচ্ছে।’
‘আর ওই যে আনস্মার্ট ফেস্ ভ্যালু ঝন্টু?’
ফুয়াদ ভাই জিজ্ঞেস করেন। ‘ওই যে জেল মেরে যে স্টার হয়েছে?’
‘জেল মেরে না’, শুধরে দিই আমি, ‘তেল মেরে। তেল মেরে ও জেলদের টপকে গেছে—! তেলের ওপর জেলাস হচ্ছে!’
‘যাই হোক, আমাদের দরকার নেই জেনে, কে তেল ভ্যালু আর কে জেল ভ্যালু—আমাদের দরকার ফেস্ ভ্যালু,’ ফুয়াদ ভাই বলেন।
মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। কেমন যেন একটা অপরাধবোধ পেয়ে বসল আমাকে। মন্দা অপরাধবোধ বোধ হয়!
তিন.
লিভিং রুমটাকেই আমরা ইন্টারভিউ রুম হিসেবে ব্যবহার করি। প্রচুর সাড়া এসেছে ফুয়াদ ভাইয়ের চতুর বিজ্ঞাপনে। বারান্দায় প্রার্থীদের সামাল দিচ্ছেন ফুয়াদ ভাই। ইন্টারভিউ বোর্ডে লিমা, ফুলা ভাই এবং আমি।
‘নে-ক্স-ট্—!’ ফুলা ভাইয়ের বম্ব ফাটল। একটি সুদর্শনা মেয়ে প্রবেশ করল। লিমা ফাইলের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘সাবজেক্ট?’
‘মডেলিং।’ মেয়েটির সোজাসাপ্টা উত্তর।
‘রুমের ওপাশ থেকে এপাশটায় ক্যাটওয়াক করেন তো,’ লিমার কমান্ড।
ফণা তোলা সাপের মতো হেঁটে আসে মেয়েটি।
গালে হাত দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলেন ফুলা ভাই, ‘কী সুন্দর বেতের মতো শরীর—জিমন্যাস্টদের মতো—হাড্ডিগুড্ডি নাই—!’
ফিসফিসিয়ে বলি, ‘প্লিজ ফুলা ভাই—ল্যাঙ্গুয়েজ! এনিওয়ে, আরেকটু TALL হলে ভালো হতো।’
‘ডোন্ট ওরি, ভাইয়া—আমি হিল পরে আরও উঁচা-লাম্ফা হতে পারমু—!’
চমকে উঠে তিনজন পরস্পরের দিকে তাকাই।
ফুলা ভাই বলেন, ‘অসুবিধা নেই। উনি তো আর মুখে কথা বলবেন না। চুপচাপ মডেলিং করবেন।’
মেয়েটি লিমার কাছ থেকে একটা অটোগ্রাফ নিয়ে চলে যায়। ‘আসি আফা—! ওয়াচ মি। দেইখেন।’
চার.
‘নে-ক্স-ট্!’ ফুলা ভাইয়ের বম্ব।
একজন ছেলে ঢোকে হাতে ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে।
লিমা ফাইলে চোখ রেখে বলে, ‘সাবজেক্ট?’
ছেলে: ক্যামেরাম্যান।
ফুলা ভাই: আগের কোনো অভিজ্ঞতা?
ছেলে: নয়টি বিয়ের ভিডিও করেছি।
লিমা: তাহলে আর এখানে এসেছেন কেন? ক্যামেরাম্যান তো হয়েই গেছেন। বিসমিল্লাহ বলে শুরু করে দেন।
ফুলা ভাই: পুরো ফি দিয়েছেন তো?
ছেলে: জি।
ফুলা ভাই: তাহলে আসুন। ডিরেক্টর হতে চাইলে আরেকবার ফি দিতে হবে।
লিমার অটোগ্রাফ নিয়ে উধাও হয় ছেলেটি।
ভীষণ অপরাধবোধে ভুগতে থাকি। কেন যে দুই ‘ফু’র গ্রিক-ইতালীয় ফাঁদে পা দিতে গেলাম। আর ফুলা ভাইয়ের প্রতিটি ‘নেক্সট্’-এ আমার নেক্সট্ অপরাধবোধ বাড়তে থাকে।
পাঁচ.
ব্রেকিং নিউজ
ফুয়াদ ভাইয়ের হঠাত্ মানসিক রোগ হয়েছে। ঘুমের মধ্যে উনি একই স্বপ্ন বারবার দেখে জেগে উঠছেন। স্বপ্নটি হচ্ছে—উনি দেখেন একটি ঝুলন্ত হাড় ওনার সামনে আর হঠাত্ কোনো অদৃশ্য আঘাতে হাড়টি ভেঙে টুকরো হচ্ছে আর উনি ব্যথায় কঁকিয়ে উঠছেন।
ডাক্তার ওষুধ দিয়েছেন। একটি মেটালিক হাড় ঝুলিয়ে দিয়েছেন ফুয়াদ ভাইয়ের বেডের স্ট্যান্ডে। আর যখনই ঘুমন্ত ফুয়াদ ভাই দুঃস্বপ্নে মোচড় দিয়ে উঠছেন, তখনই হাতের কাঠি দিয়ে ধাতব হাড়ে ঘণ্টি বাজিয়ে জাগিয়ে দিচ্ছেন ফুয়াদ ভাইকে।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কারণ?’
ডাক্তার বললেন, ‘এতে করে ঘুম থেকে উঠে উনি বুঝতে পারবেন যে, বাড়ি খেলে হাড় শব্দ করতে পারে, কিন্তু সহজে ভাঙে না। ধীরে ধীরে উনি হাড়-ভাঙা-ভীতি থেকে কনফিডেন্স নিয়ে ফেরত আসবেন।’
ছয়.
ফোন বেজে ওঠে। সেই মডেল মেয়েটির ফোন।
আমি: হ্যালো।
মেয়ে: হ্যালো—আমারে চিনেছেন? আচ্ছা শুনলাম কী যেন হাড্ডিগুড্ডি—।
আমি: তাতে কী? আপনার তো হাড্ডিগুড্ডি নেই।
মেয়ে: ইউ আর সো সুইট—।
আমি: থ্যাঙ্কু বোনলেস—।
মেয়ে: ইউ আর সো সুইটমিট—!
প্রশংসা ক্রমেই অশ্লীলতার দিকে এগোচ্ছে দেখে ফোন এখানে কেটে দিলাম।
শায়ের খান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২৩, ২০০৯
Leave a Reply