বাবা মৃত্যুশয্যায়। পুত্রকে ডেকে পাঠালেন।
—বাবা, ডেকেছ?
—হ্যাঁ, আমার ডাক এসে গেছে, যাওয়ার আগে একটা শেষ উপদেশ দিতে চাই।
—বাবা, সারা জীবন তোমার উপদেশ শুনে এসেছি। শেষ বেলায় এসে আর বিয়ে করতে নিষেধ কোরো না। মলিকে আমি কথা দিয়ে ফেলেছি।
—না না, আমি এতটা অবিবেচক বাবা নই। আমি আধুনিক যুগের বাবা, তবে… তবে একটা অনাধুনিক উপদেশ দিতে চাই…।
—কী?
—আগের যুগে সবাই বাসর রাতে বিড়াল বধ করত… এ কাজটা আমি না করে বিরাট ভুল করেছিলাম…।
—করোনি কেন?
—আসলে করেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে বিড়ালটি ছুটে পালিয়ে যায়। সেই জন্য বলছিলাম, অন্তত দুইটা বিড়াল রাখবে। একটা ছুটে গেলে আরেকটা… এটাই আমার শেষ উপদেশ… আশা করি তাহলে বাকি জীবন সুখে থাকতে পারবে! বলে বাবা চোখ বুজলেন। পুত্র একবার ভাবল, পিতার শেষ নিঃশ্বাস পতনে হাউমাউ খাউ করে কেঁদে উঠবে, তা না করে পকেট থেকে মোবাইল বের করে মলিকে ফোন দিল।
আমাদের গল্পের সদ্য পিতৃহারা পুত্রের নাম ধরা যাক জগলুল, জগলুল হায়দার। সে পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র। ইচ্ছে ছিল ভালো রেজাল্ট করে বড় বিজ্ঞানী হবে, সে সম্ভাবনার চিটাগুড়ে কক্সবাজার সি বিচের বালি ফেলে সে এখন একটা প্রাইভেট ব্যাংকের ক্যাশিয়ার। বন্ধুরা তাকে তার চাকরি নিয়ে ঠাট্টা করে বলে, ‘তুই একটা অপদার্থ, নইলে পদার্থবিজ্ঞান পড়ে ব্যাংকের ক্যাশিয়ার? এর চেয়ে বাপের হোটেলে বেকার ম্যাসিয়ার ছিলি, সেটাই বরং ভালো ছিল!’ বন্ধুদের ঠাট্টা-তামাশায় কান না দিয়ে সদ্য পিতৃহারা পুত্র জগলুল এবার সংসারের দিকে মন দিল। মলিকে বিয়ে করল। তবে বাবার শেষ উপদেশ পালনের সিদ্ধান্তও নিল। যদিও মলির সঙ্গে তার টানা চার বছরের ক্রমিক প্রেম!
বাসর রাত। দক্ষিণের জানালা হাট করে খোলা। নতুন বাড়ি বলে গ্রিল লাগানো হয়নি এখনো। হু হু করে বাতাস ঢুকছে। আকাশে পূর্ণ চাঁদ। খুবই রোমান্টিক পরিবেশ।
—খাটের নিচে একটা বাক্স দেখছি। নববধূ মলি বলে।
—হুঁ
—কিসের বাক্স? আবার দড়ি দিয়ে বাঁধা।
—ইয়ে মানে ও কিছু না… একটা একটা… জগলুল ইতস্তত করে!
—একটা?
—একটা না দুটা
—দুটা কী?
—দুটা বিড়াল।
—বাক্সের ভেতর দুটা বিড়াল?
—হ্যাঁ, শ্রডিঙ্গারের বিড়াল। এই বাক্সের ভেতর একটা গাইগার আছে, আর আছে সায়ানাইড গ্যাস আর হাতুড়ি… বিড়াল তো আছেই… বাক্সটা না খোলা পর্যন্ত ওই বাক্সে আছে দুটি বিড়াল, একটি মৃত আর একটি জীবিত… (বাবা বলেছিলেন দুটি বিড়াল রাখতে) বিজ্ঞানী শ্রডিঙ্গারের বিখ্যাত সূত্রটা গভীর আবেগে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র জগলুল হায়দার… সে ভুলে যায় যে সে একটা প্রাইভেট ব্যাংকের ক্যাশিয়ার…সদ্য পিতৃহারা পুত্র এবং সদ্য স্বামী, মলির… সে এই মুহূর্তে কোয়ান্টাম মেকানিকসের জনক শ্রডিঙ্গারের ভাবশিষ্য যেন!
তবে খুব বেশিক্ষণ তার বক্তৃতা চালাতে হয় না। মৃদু নাসিকা গর্জনে জগলুল খেয়াল করে, নববধূ …তার চার বছরের ক্রমিক প্রেমিকা মলি উঁচু বালিশে হেলান দিয়ে দিব্যি ঘুমাচ্ছে। এই সময় ঘরে বাসর রাতের ফুলের গন্ধ অতিক্রম করে কেমন একটা বোটকা গন্ধ টের পায় জগলুল। তবে কি শ্রডিঙ্গারের জীবিত ও মৃত বিড়াল প্রাকৃতিক কাজ সারল বাক্সের ভেতর? সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে জগলুলের চোখজোড়াও নিমীলিত হয়ে আসে… এই সময় বাইরে একটা অস্পষ্ট হাউ-কাউয়ের শব্দ শোনা গেল।
কতক্ষণ তারা ঘুমিয়ে ছিল বলা মুশকিল। তবে মলির ধাক্কায় ঘুম ভাঙল জগলুলের।
—এই? এই?
—কী হলো?
—খাটের নিচে তোমার বিড়াল দুটা মনে হয় বের হয়ে গেছে… খচর-মচর শব্দ করছে। ওদের ঘর থেকে বের করো তো… বোটকা গন্ধও বের হয়েছে!
—বিড়াল তো একটা।
—তুমি যে বললে দুটা?
—সেটা পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায়…জগলুল খাটের নিচে হাত ঢোকায়। হ্যাঁ, মলির কথা হয়তো ঠিকই, বাক্স ছিঁড়ে বিড়াল বের হয়ে গেছে। হতেই পারে, জুতার বাক্স আর কত শক্ত হবে। কিন্তু বিড়ালটা এত বড় কেন? আন্দাজে ঘাড়ের কাছে ধরে (বিড়ালকে ওভাবেই ধরতে হয়) খাটের তলা থেকে বের করে আনে জগলুল। ঘরের লাইট জ্বলাই ছিল। হঠাত্ একটা আর্তচিত্কার দিতে দেখে মলিকে। তার পরই বিছানায় পড়ে জ্ঞান হারায় মলি। এবার নিজের হাতে ধরা বিড়ালটার দিকে তাকায় পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র জগলুল, তার হাতে ধরা একটা মাঝারি সাইজের রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ঠিক এই সময় হুড়মুড় করে দরজা ভেঙে কয়েকজন ঢোকে, ‘এই যে, এই যে, এই ঘরে পেয়েছি ব্যাটাকে, খোলা জানালা দিয়ে ঢুকেছে, ভাই শক্ত করে ধরে থাকুন, ব্যাটা চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়েছে … এই জালটা। এদিকে ধরো…।’
বাকি জীবন জগলুল হায়দার সুখে কাটিয়েছে।
আহসান হাবীব
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২৩, ২০০৯
Leave a Reply