ক্রিকেট নাকি ভদ্রলোকের খেলা! যে ভদ্রলোক এই অমৃতবচন জন্ম দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁর আত্মা শান্তি লাভ করুক। কারণ হাল আমলে ক্রিকেট মাঠে হররোজ যেসব কাণ্ডকারখানার জন্ম হচ্ছে, তাতে স্বর্গে বসে ওই ভদ্রলোক নিশ্চয় মাথার চুল ছিঁড়ছেন রাগে-ক্ষোভে-হতাশায়। তবে মাঠে ব্যাট-বলের পাশাপাশি দুই পক্ষের কথার লড়াইটাও কিন্তু ক্রিকেটের ইতিহাসের মতোই শতবর্ষী পুরোনো। কেতাবি ভাষায় যেটিকে বলে ‘স্লেজিং’। আর যে স্লেজিংয়ের জুতসই সংজ্ঞা দিতে গিয়ে জনৈক ক্রিকেটবোদ্ধা বলেছেন, ‘অস্ট্রেলীয়রা যাহা বলে তাহাই স্লেজিং!’ তার মানে কি অস্ট্রেলীয়দের মুখে সব সময় খিস্তিখেউরের তুবড়ি ছোটে? ওই বোদ্ধার জবাব, ‘না, তা কেন। অনেক সময় তারা ভালো ভালো কথাও বলে।’ কখন? ‘যখন তাদের মুখ বন্ধ থাকে!’
তার মানে কিন্তু এই না, অস্ট্রেলীয়রাই স্লেজিংয়ের জন্মদাতা। বিশ্ব ক্রিকেটের মতো এই জায়গাতেও তারা চ্যাম্পিয়ন—এই যা। আসলে আধুনিক ক্রিকেটের জনক ডব্লিউ জি গ্রেস সেই আদ্দিকালে ক্রিকেটের বেশ কিছু স্মরণীয় স্লেজিংয়ের জন্ম দিয়ে গেছেন। যেগুলোকে চুটকি বলাই ভালো। একবার তো ডাক্তার গ্রেস নাকি বোল্ড হওয়ার পর আম্পায়ারের দিকে ফিরে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আসলে ঝোড়ো বাতাসে বেল পড়ে গেছে।’ প্রত্যুত্তরে ওই আম্পায়ার বলেছিলেন, ‘আশা করি বাতাসটি আরেকটু ঝোড়ো গতি পেয়ে ডাক্তার সাহেবকে প্যাভিলিয়নে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।’
আরেকবার গ্রেস গেছেন গ্রামে খেলতে। সেখানকার এক অখ্যাত বোলার একেবারে প্রথম বলে আউট করে দিল গ্রেসকে! কিন্তু তিনি হাল ছাড়বেন কেন? ‘ট্রায়াল বল হিসেবে প্রথম বলটা ভালোই করেছ বাছা। বেশ তবে, এবার শুরু হোক আসল খেলা’ বলে আবারও গিয়ে দাঁড়ালেন উইকেটে!
আউট হতে একেবারেই ইচ্ছে করত না গ্রেসের। আম্পায়াররাও বোধহয় তাঁর এই ইচ্ছেটাকে সম্মান করতেন। ১৮৯৮ সালের এক ম্যাচে গ্রেসের বিপক্ষে একাধিকবার এলবিডব্লিউর আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হলেন ফাস্ট বোলার চার্লস কোর্টনাইট। শেষে রেগেমেগে একেবারে দুটো স্ট্যাম্পই দিলেন উপড়ে। বোল্ড! এরপর গ্রেসের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘ডক্, তুমি এবারও নিশ্চয়ই মাঠ ছাড়বে না। একটা স্ট্যাম্প তো এখনো দাঁড়িয়েই আছে, নাকি?’ আউট না হতে চাওয়ার পরিষ্কার যুক্তি ছিল গ্রেসের। ‘লোকে গাঁটের টাকা খরচ করে আমার ব্যাটিং দেখতে এসেছে, তোমার বোলিং নয়’—বোলারের উদ্দেশে এই ছিল তাঁর বাণী!
কিন্তু স্লেজিং এমন নির্দোষ চটুল বাক্যবিনিময়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি। অস্ট্রেলীয়রা সেটিকে নিয়ে গেছে শিল্পের পর্যায়ে। সেই কাহিনী বিশদ-বৃত্তান্ত লিখতে গেলে কয়েক দিস্তা কাগজ দরকার। তার ওপর এর অধিকাংশ ছাপার অক্ষরে প্রকাশযোগ্য নয়। পাছে আপনারাই আমাকে মন্দ লোক ঠাওরে বসবেন।
তার পরও ঘষেমেজে, সেন্সর করে, কয়েকটি ভদ্রগোছের স্লেজিং পরিবেশন করার লোভ সামলাতে পারছি না। এক অ্যাশেজের ঘটনা। ব্যাট করতে এসেছেন ইয়ান বোথাম। রড মার্শ এগিয়ে গিয়ে তাঁকে ‘স্বাগত’ জানালেন, ‘হাই ইয়ান, তোমার বউ আর আমার বাচ্চারা কেমন আছে?’ বোথামের জবাব, ‘বউ ভালোই আছে। কিন্তু বাচ্চারা সব বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মেছে দেখছি!’ পরের এই গল্পটাতেও বোথাম আছেন। এখন যেমন কোনো দল পাকিস্তান সফরে রাজি হচ্ছে না, তেমনি নিরাপত্তা শঙ্কায় আগেও ভুগেছে দলগুলো। আশির দশকে পাকিস্তান সফর থেকে ফেরার পর বোথাম তো ঘোষণাই দিয়ে দিলেন, ‘পাকিস্তান এমন একটা দেশ, যেখানে আপনি আপনার শাশুড়িকে পাঠিয়ে দিতে পারেন।’ ইঙ্গিত পরিষ্কার, ব্রিটিশদের জামাই-শাশুড়ির চিরায়ত দ্বন্দ্ব দিয়ে পাকিস্তানের পরিস্থিতি বোঝানো। সেটা ভালোই বুঝেছিলেন পাকিস্তানের আমির সোহেল। প্রতিশোধ নিয়েছিলেন ১৯৯২ বিশ্বকাপের ফাইনালে। প্রতিটা রানের জন্য যুঝতে থাকা বোথামকে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার বদলে তোমার শাশুড়িকে ব্যাট করতে পাঠাও। নিশ্চয় তিনি তোমার চেয়ে ভালো করবেন।’
পরের এই ঘটনার নায়ক গ্লেন ম্যাকগ্রা আর জিম্বাবুয়ের ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান এডো ব্র্যান্ডেস। ম্যাকগ্রার বল কিছুতেই ব্যাটে লাগাতে পারছিলেন না ব্র্যান্ডেস। কিন্তু আউটও হচ্ছিলেন না। অধৈর্য হয়ে ম্যাকগ্রা ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন ব্র্যান্ডেসের দিকে, ‘এডো, তুই কেন এত মোটা?’ ব্র্যান্ডেসের উত্তর, ‘হব না, যতবার তোমার স্ত্রীর কাছে যাই, ততবারই ও আমাকে যে বিস্কুট খেতে দেয়।’
শরীরের আকার-আকৃতি নিয়ে খোঁচা দেওয়ার বেশ কয়েকটা গল্প আছে ক্রিকেটে। ১৯৯১ সালের অ্যাডিলেড টেস্টে মার্ভ হিউজকে ‘মোটকু বাস কন্ডাক্টর’ বলেছিলেন জাভেদ মিয়াঁদাদ। সম্বোধনটা হিউজের পছন্দ হয়নি। তাঁর বলেই মিয়াঁদাদ আউট হওয়ার পর হিউজ বড়েমিয়াঁর গতিরোধ করে দাঁড়ান। এক হাত পেতে দিয়ে বলে ওঠেন, ‘টিকিট, প্লিজ!’
ফাস্ট বোলাররা তাঁদের বলের গতির মতোই উগ্র মেজাজের হয় বলে অধিকাংশ স্লেজিংয়ের জোগান তাঁদের কাছ থেকেই পাওয়া যায়। আবার ফাস্ট বোলারদের খোঁচা দেওয়ার সবচেয়ে মোক্ষম জায়গা হলো তাঁদের বলের গতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা। বিশ্বের অন্যতম দ্রুতগতির বোলার ব্রেট লিকে একবার ইনজামাম-উল হক কী বলেছিলেন জানেন? বলেছিলেন, ‘অফ স্পিন করা বাদ দাও।’
শুধু ফাস্ট বোলার নয়, শেন ওয়ার্নের মতো স্পিনারকে নিয়েও প্রচুর গল্প ছড়িয়ে আছে। সেটার রসদ এত অফুরান, এ নিয়ে পুরো একটা কেচ্ছাই হবে রস+আলোর অন্য কোনো সংখ্যায়। কিন্তু হঠাত্ স্লেজিং নিয়ে মগ্ন হওয়া কেন? কারণ ব্রেট লির সাম্প্রতিক একটা মন্তব্য, অস্ট্রেলীয়রা নাকি আর স্লেজিং করে না! অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটারদের শ্রীমুখ থেকে নাকি আর কোনো বিশ্রী বাক্য বের হতে শুনবে না কেউ! কী বলবেন একে? ভূতের মুখে রাম নাম নাকি ব্যাঙের সর্দি?
রাজীব হাসান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১৬, ২০০৯
Leave a Reply