ঘরে বসে সহজে টাকা কামানোর রাস্তা হিসেবে এখন সবাই ছুটছে শেয়ারবাজারে। গরম এই বাজারে যারা নামবেন নামবেন করছেন, তাঁদের জন্যই এবারের রস+আলোর রস মলাট
শহরভর্তি বানর। বানরের যন্ত্রণায় টেকা দায়। সেই সময় শহরে এল এক আগন্তুক। এসেই ঘোষণা দিল, একেকটি বানর ধরে দেওয়ার জন্য দেওয়া হবে ১০ টাকা। কয়েক দিনের ভেতরই শহরবাসীর প্রধান কাজই হয়ে গেল বানর ধরা। বানর ধরে খাঁচায় পুরে ১০ টাকা করে নিয়ে বাড়ি ফিরল সবাই।
এরপর ঘোষণা এল, একটি বানরের জন্য এবার দেওয়া হবে ২০ টাকা। শহরবাসী আবার নেমে গেল বানর ধরতে। খুব বেশি পাওয়া গেল না, যা পাওয়া গেল তাতেও মুনাফা কম হলো না। এবার ঘোষণা এল, বানরপ্রতি ৩০ টাকা করে দেওয়া হবে। শহরবাসী আবার নামল বানর সংগ্রহে। অনেক কষ্ট করে এবার পাওয়া গেল কয়েকটা মাত্র।
ঘোষণা কিন্তু বন্ধ হলো না। আবার ঘোষণা হলো, এবার ধরে দিতে পারলে বানরপ্রতি দেওয়া হবে ৪০ টাকা। শহরের মানুষজন সবাই মিলে অনেক খুঁজেও একটার বেশি বানর পেল না। আগন্তুক তাতেও সন্তুষ্ট নয়। ঘোষণা দেওয়া হলো, এবার দেওয়া হবে ৫০ টাকা। এবার কেউ একটা বানরও ধরে দিতে পারল না। কিন্তু শহরবাসী খুঁজেই চলেছে। আর এই সুযোগে আগন্তুক কিছুদিনের জন্য তার এক সহকারীকে দায়িত্ব দিয়ে অন্য এক শহরে গেল।
আমাদের এই সহকারীর আবার কিঞ্চিত্ স্বভাবের দোষ আছে, আর শহরবাসীর আছে খানিকটা লোভ। দ্রুতই সে শহরবাসীর দলে ঢুকে গেল। প্রস্তাব দিল, খাঁচায় আটকে রাখা বানরগুলো সে ৩৫ টাকায় বিক্রি করে দিতে রাজি আছে। শহরবাসী ভাবল, ভালোই তো, ৩৫ টাকায় কিনে ৫০ টাকায় বিক্রি করা যাবে। গোপন চুক্তি অনুযায়ী, শহরবাসীর হাতে ছেড়ে দেওয়া হলো সব বানর। কিন্তু সেই আগন্তুক আর ফিরে এল না, সহকারীও লাপাত্তা। শহর আবার ভরে গেল বানরে।
এটাই হচ্ছে আসলে শেয়ারবাজার। সবাইকে স্টক মার্কেটে স্বাগতম।
বাঙালি যেহেতু, এ কথা নিশ্চয়ই সবাই শুনেছেন—আজ যা বাংলা ভাবে, সারা বিশ্ব তা ভাববে আগামীকাল। কথাটা নতুন করে টের পাওয়া যায় এবারের বিশ্বমন্দার সময়। বিশ্বমন্দায় ইন্টারনেটে ছড়িয়ে গেল একটা গল্প। যুক্তরাষ্ট্র নাকি নতুন এক মারণাস্ত্র আবিষ্কার করেছে। তাতে ভবন, রাস্তাঘাট ঠিক থাকে, শুধু মানুষগুলোই উধাও হয়ে যায়। আর সেই মারণাস্ত্রের নাম শেয়ারবাজার।
বাংলাদেশ তো এই অস্ত্র আবিষ্কার করে বসে আছে সেই ১৯৯৬ সালেই। সেই যে ঘটিবাটি বিক্রি করে সবাই মতিঝিলের রাস্তায় নেমে গিয়েছিল। তারপর কীভাবে হাজার হাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী সর্বস্ব হারিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল, তাও নিশ্চয়ই সবার জানা। এরপর মনে হয় আর কাউকে বলে দিতে হবে না শেয়ারবাজার কী বা কাকে বলে।
এর পরও যাঁরা জানেন না, তাঁদের একটু বুঝিয়ে বলি। শেয়ারবাজার হলো এমন এক বাজার, যেখানে প্রতিদিন সকালে দুই দল মানুষ মিলিত হয়। এর মধ্যে একদলের থাকে অর্থ, আরেক দলের অভিজ্ঞতা। দিন শেষে তারা কেবল নিজেদের সম্পদ হাতবদল করে। যাদের অর্থ ছিল, তারা অভিজ্ঞতা নিয়ে বাড়ি ফেরে, আর অভিজ্ঞরা ফেরে অর্থ নিয়ে।
সুতরাং শেয়ারবাজারের প্রথম পাঠই হচ্ছে, অর্থ আয় করতে হলে অভিজ্ঞ হতে হবে। জানেন তো, শেয়ারবাজারে তিন ধরনের বিনিয়োগকারী থাকে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ বাজারের কিছুই জানে না। ১০ শতাংশ আছে, যারা কিছুটা জানে। আর ৮০ শতাংশ জানে না যে তারা আসলে কিছুই জানে না। সুতরাং আপনাকে কিছু জানার দলে থাকতে হবে।
জানতে যাওয়ার হ্যাপাও কম নয়। এক নব্য বিনিয়োগকারী ভাবলেন তাঁকে কিছু জানতে হবে। চলে গেলেন এক ব্রোকারের বাসায়। ড্রয়িং রুমে বসে আছেন ব্রোকার ভদ্রলোকের অপেক্ষায়, রুমে ঢুকল ছয় বছরের এক ছেলে। তিনি কথা বলতে লাগলেন ছেলেটার সঙ্গে।
—তোমার বাবা কই? কী করেন তিনি?
—আমার বাবা মাছ ধরে।
একটু খাবি খেলেন তিনি। অবাক হয়ে বললেন, মাছ ধরে?
ছেলেটা মাথা দুলিয়ে বলল, মাছই তো ধরে। বাবার কাছে আপনার মতো লোকজন আসে, চলে যাওয়ার পর আমার বাবা মাকে বলে, আরও একটা বড় মাছ ধরলাম। ভালোই লাভ হবে।
সেই নব্য বিনিয়োগকারী ভদ্রলোক এই ব্রোকারের অপেক্ষায় আর ছিলেন কি না, তা অবশ্য জানা যায় না। নিউইয়র্ক শহরে একবার চরম ঠান্ডা পড়েছিল। ওয়াল স্ট্রিটের এক নামকরা ব্রোকারকে সে সময় নিজের প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একবার হাঁটতে দেখা যায়। ওই একবারই নাকি ব্রোকাররা নিজের পকেটে হাত দিয়েছিলেন, আর বাকি সময় তাঁদের হাত থাকে অন্যের পকেটে।
বাংলাদেশে অবশ্য সবাই যে হারে শেয়ারবাজারের দিকে ছুটছে, তাতে অন্যের পকেটে হাত দেওয়া ব্রোকারের ইন্ধনের প্রয়োজন হচ্ছে না। যা কিছু আছে বিক্রি করে সহজে বড়লোক হওয়ার আশায় ভিড় করছে শেয়ারবাজারে। কাজকর্মে মন নেই, চোখ সারাক্ষণ স্টক মার্কেটের খবরের দিকে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইট খুলে বসে থাকার লোকজন ক্রমেই বাড়ছে, তাও আবার জ্যামিতিক হারে। আর কেউ কেউ তো অফিসই করেন না।
বড় সাহেব অফিসে গিয়েই খবর দিলেন ক্যাশিয়ারকে। কিন্তু ক্যাশিয়ার সাহেব আর আসেন না। বারবার খবর দিয়েও পাওয়া গেল না। শেষে হাত কচলাতে কচলাতে অফিসের ম্যানেজার এসে জানালেন, ক্যাশিয়ার অফিসে নেই, স্টক মার্কেটের দিকে গেছে।
—স্টক মার্কেটে কেন?
—তিনি তিন দিন ধরেই যাচ্ছেন, কিন্তু তাকে বলে দেওয়া হয়েছে যে আজই শেষ দিন।
—শেষ দিন কেন?
—না মানে, হিসাব মিলছে না তো, তাই শেষ চেষ্টা হিসেবে শেয়ারবাজারে গেছে। আজও যদি টাকা নিয়ে এসে হিসাব মেলাতে না পারে তাহলে তো পুলিশকে খবর দিতেই হবে।
এই দেশটির মানুষের আয় কম। আয় আর ব্যয়ের হিসাব মেলে না। ফলে নানাভাবে এই হিসাব মেলাতে হয়। আর এই হিসাব মেলানোর নতুন জায়গা হয়েছে শেয়ারবাজার।
যারা নিয়মিত হিসাব মেলাতে যান এবং শত ভয় দেখালেও বাজার ছেড়ে যাবেন না, তাঁদের জন্য আরও তিনটি শিক্ষা। আমি নিজে দিলে কেউ মানবে না। তাই বিখ্যাত তিনজনের তিনটি কথা বলা যায়।
উইলিয়াম আর্থার ওয়ার্ড নামের একজন মার্কিন ভদ্রলোক লিখেছিলেন, ‘ইনভেস্ট করার আগে ইনভেস্টিগেট করো।’
বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী বিনিয়োগগুরু ওয়ারেট বাফেট বলেছেন, ‘আমি কখনো স্টক মার্কেট থেকে অর্থ কামানোর কথা ভাবি না। আমি সব সময় ভাবি, যে শেয়ারটা কিনব সেটি পরদিনই বন্ধ হয়ে যাবে, আর পরের পাঁচ দিনেও লেনদেন হবে না।’
বার্নার্ড বারুখ নামের একজন মার্কিন বিনিয়োগকারী বলেছিলেন, ‘কখনো সর্বনিম্ন দামে শেয়ার কেনার চেষ্টা কোরো না, আর সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রির চেষ্টাও কোরো না।’
এতসব কথা কেন বললাম? অন্যকিছু ভাববেন না, জাস্ট একটু শেয়ার করলাম আর কি!
শওকত হোসেন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ০৯, ২০০৯
Leave a Reply