ঘুম থেকে উঠে একবার, আর স্কুল থেকে ফিরে এসে একবার, রোজই দিনে দুবার ব্যায়ামচর্চা করে হাবুল। ডন আর বৈঠক, বৈঠক আর ডন।
পরেশবাবু নিজেই ছেলেকে উত্সাহিত করেছিলেন—এ ছাড়া পার্কের চারদিকে অন্তত দু-চক্কর দৌড়ে আসবি হাবুল। দৌড় প্র্যাকটিস করলে শরীরে খুব উপকার হয়। দম বাড়ে, খিদেও বাড়ে; হজম হয় ভালো।
শুধু ডন আর বৈঠকের কৃপাতেই হাবুলের শরীরের অনেক উপকার হয়েছে। যেমন খিদে, তেমনি হজম। গত বছরের তুলনায় এই বছরে প্রতি মাসে ১০ সের বেশি আটা আনতে হয়েছে। আগে ছোলা আনা হতো মাসে এক সের, এখন আনতে হয় ছয় সের।
হাবুলের মা বলেন—শুধু পিণ্ডি পিণ্ডি রুটি আর ছোলা খাবে, এই জন্যেই কি কসরত?
পরেশবাবু বলেন—খাক না, ছেলেটার স্বাস্থ্যটা তো দিন দিন ভালো হয়ে উঠছে।
সেই পরেশবাবুই সেদিন অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যার অন্ধকারে ঘরের ভেতর চুপ করে বসে ভাবতে ভাবতে হঠাত্ চেঁচিয়ে উঠলেন—বারান্দার ওদিকে ও রকম বিশ্রী ভোঁস ভোঁস করছিস কে রে?
হাবুল হাঁপাতে হাঁপাতে বলে—আমি, আমি এক্সারসাইজ করছি বাবা।
—তা এতক্ষণ ধরে কেন?
—তুমিই যে বলেছিলে বাবা। আজকাল ডন ৫০টা আর বৈঠক ১০০টা বাড়িয়েছি।
—না, না, আর বাড়াতে হবে না। বরং একটু কম কর।
—আচ্ছা বাবা।
—তা ছাড়া, পার্কে গিয়ে আর দৌড়াদৌড়ি করিস না।
হাবুলের মা শুনতে পেয়ে আশ্চর্য হয়ে যান। আর এগিয়ে এসে প্রশ্ন করেন—কী হলো? আজ হঠাত্ ছেলেটার কসরত দেখে রাগ করছ যে?
খেঁকিয়ে ওঠেন পরেশবাবু।
—১৫ টাকা মাইনে কমেছে যে। অফিসের প্রত্যেকের মাইনে শতকরা ২০ কাট হয়েছে।
হাবুলও পরেশবাবুর কথামতো ডন-বৈঠক কমিয়ে দেয় ঠিকই। সারা দিনের মধ্যে মোট ৩০টা ডন আর ৫০টা বৈঠক। পরেশবাবু বলেন—ব্যস, এই ঢের। এর চেয়ে বেশি দরকার নেই।
কিন্তু তবু দেখা যায়, হাবুলের খোরাক এক ছটাকও কমে না। রুটির স্তূপের দিকে তাকিয়ে হাবুল বলে—আরও অন্তত চার-পাঁচটা বেশি না হলে পেটে পোষাচ্ছে না মা।
পরেশবাবু বলেন—কেন রে? ডন-বৈঠক তো কমিয়ে দিয়েছিস, তবু তোর খোরাক যে বেড়েই চলেছে।
হাবুল—ডন-বৈঠক কমিয়েছি। কিন্তু মুগুর, ডাম্বেল ধরেছি যে।
—অ্যাঁ? চমকে ওঠেন পরেশবাবু। তার পরই গম্ভীর হয়ে বলেন, মুগুর আর ডাম্বেল পেলি কোত্থেকে?
—মানিকদা এক মাসের জন্য ধার দিয়েছেন।
কিন্তু এক মাসও পার হয়নি। সেদিন অফিস থেকে ফিরে এসে সন্ধ্যার অন্ধকারে ঘরের ভেতর মেঝের ওপর অসাড় হয়ে শুয়ে রইলেন পরেশবাবু।
বারান্দার ওদিকে ভোঁস ভোঁস শব্দ শুনেই এক লাফ দিয়ে উঠলেন। তারপর ছুটে গিয়ে হাবুলের হাত থেকে একটা মুগুর কেড়ে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন—আজ তোরই দফারফা করে দেব।
হাবুল আশ্চর্য হয়ে তাকায়। ভয় পেয়ে ছুটে আসেন হাবুলের মা। —কী হলো?
পরেশবাবু বলেন—ওকে তুমিই একটু বুঝিয়ে দাও।
হাবুলের মা—কী বুঝিয়ে দিতে বলছো?
পরেশবাবু—এক্সারসাইজ করতে নেই। শরীরের হাড়-মাংসগুলোকে অসভ্য করে তুলে কোনো লাভ নেই। এক্সারসাইজ করলে মানুষ রাক্ষস হয়ে যায়।
আস্তে আস্তে হেঁটে চলে গেলেন, আবার ঘরের ভেতর গিয়ে বসলেন পরেশবাবু। হাবুলের মা বলেন—এবার আসল কথাটি বলো তো কী হয়েছে?
—ছাঁটাইয়ের লিস্টে নাম চড়েছে। পরেশবাবু করুণ স্বরে বিড়বিড় করেন।
সুবোধ ঘোষ: ভারতীয় লেখক।
জন্ম-১৯০৯, মৃত্যু-১৯৮০।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ০৯, ২০০৯
Leave a Reply