১৬৮০ সালে ওভিদ-এর ইংরেজি সংস্করণের ভূমিকায় ড্রাইডেন তিন ধরনের সম্ভাব্য অনুবাদের কথা বলেছিলেন—আক্ষরিক মূলানুগ আর ভাবানুবাদ। আক্ষরিক অনুবাদের লক্ষ্য হলো শব্দের পর শব্দ ধরে হুবহু অনুবাদ। মূলানুগের লক্ষ্য আক্ষরিকতার সীমাবদ্ধতাকে এড়িয়ে অর্থ এবং শৈলীর দিক থেকে যথাসম্ভব বিশ্বস্ত থাকা। সব শেষে ভাবানুবাদ রচনাকে একটা উপলক্ষ হিসেবে নিয়ে শৈলী ও কাঠামোর ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন না করে সার্থক অনুবাদের দিকে এগিয়ে যাওয়া। সন্দেহ নেই যে এই তিনটি ধরনের মধ্যেই রয়েছে বিপদ।
আর অনুবাদ যখন সরাসরি মূল ভাষা থেকে না হয়ে অন্য আরেকটি অনুবাদের ভিত্তিতে তৈরি হয়, তখন ঝুঁকিটা আরও বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে হুয়ান রামোন হিমেনেথের তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের বিখ্যাত হিস্পানি সংস্করণকে উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। এই ভাষা না জেনে হিমেনেথ কীভাবে স্প্যানিশে অনুবাদ করলেন? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা পাব এমন এক কাহিনি, যাতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে দুই কবি, অন্যায়ভাবে বিস্মৃত এক মননদীপ্ত নারী, তিনটি ভাষা আর তিন মহাদেশ। এই বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে এক সাহিত্য প্রতিভা আর একই স্তরের আরেকজন আন্তর্জাতিকবাদীর মধ্যে এক ঐক্যের ভূমিকা পালন করেছেন।
বাংলা হচ্ছে সেই ভাষা, যার উৎস বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। এই ভাষায় রয়েছে অসাধারণ সংগীতময়তা। যেমন হিন্দি ভাষার মূল খুঁজে পাওয়া যাবে সংস্কৃত ভাষায়। ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের হওয়া সত্ত্বেও সুদৃশ্য যে-চিহ্নসমূহের সাহায্যে এই ভাষা লেখা হয় তা দেবনাগরির অনুরূপ। কবিতার প্রতি বাংলা ভাষায় রয়েছে বিশেষ সংবেদনশীলতা। এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়, যিনি স্মৃতি থেকে নির্ভুলভাবে কবিতা শুনিয়ে দিতে পারেন। গোটা ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথ কবি চূড়ামণি হিসেবে পরিচিত। স্বদেশে রবীন্দ্রনাথের অবস্থান এখনো প্রধানতম ব্যক্তিত্ব হিসেবে। বাংলাভাষী বেশির ভাগ হিন্দু, খ্রিষ্টান কিংবা মুসলমানের কাছে তিনি এক মহান কবি। একুয়াদরের লোকজনের কাছে যেমন কাররেরা আন্দ্রাদে, ফরাসিদের কাছে যেমন র্যাঁবো কিংবা আমেরিকানদের কাছে যেমন হুইটম্যান, বাঙালিদের কাছে তেমনি রবীন্দ্রনাথ। এই কবিদের মতোই বাংলা ভাষায় তাঁর উপস্থিতির সূচনা ও সমাপ্তি পাঠকের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ও কাব্যকৃতির পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যকর্ম রচনা করেছেন বাংলা ভাষায়। তাঁর পরিমাণ সন্দেহাতীতভাবে বিপুল। আয়তকার ২০ খণ্ডে তাঁর রচনাবলি প্রকাশের পরও এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। এই বিপুল ভান্ডারের মাত্র অল্প কিছু অংশই কেবল ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। শেকসিপয়রের (অর্থাৎ ইংরেজি ভাষায়) ভাষায় তাঁর সুগভীর দখলের সুবাদে রবীন্দ্রনাথের স্বকৃত অনুবাদগুলোই ছিল প্রথম এবং সুপরিচিত। এই অনুবাদগুলো প্রশংসা কুড়িয়েছিল ইয়েটস ও পাউন্ডের মতো ব্যক্তিত্বের, যা ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পক্ষে এক অনুকূল আবহ তৈরি করেছে।
অনুবাদক রবীন্দ্রনাথকে দেখে মনে হতে পারে যে তাঁর লেখার বাংলা ও ইংরেজি সংস্করণ বুঝি একই; বাস্তবতা থেকে দূরবর্তী কিছু নয়। যেমন প্রফেসর উইলিয়াম রাদিচি এবং আরও কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকেই এগুলোর মধ্যে রয়েছে ভিন্নতা। এটা নিশ্চিত যে রবীন্দ্রনাথের মতো একজন বড় প্রতিভার পক্ষে নিছক আক্ষরিক অনুবাদের স্তরে নিজেকে নামানো সম্ভব ছিল না। তাঁর মানবতাবাদী টানাপোড়েনের সঙ্গেও মূলানুগতাকে যথাযথ বলে মনে হয়নি। ফলে ইংরেজি অনুবাদ হয়ে উঠেছে সযত্নে এলায়িত এক ভাবানুবাদ যাতে করে বিদেশি পাঠকেরা সহজে প্রবেশ করতে পারে। অনুবাদে কবিতাগুলো ফ্রি-ভার্স কিংবা গদ্যের আদল গ্রহণ করেছে। বিষয়ের উল্লেখ, লোকপুরাণ ও স্থানীয় ঘটনাবলি বিলুপ্ত বা পরিবর্তিত হয়ে গেছে বোধগম্য করে তোলার লক্ষ্যে। হিন্দু মরমিবাদের উল্লেখসমূহ দূরবর্তী সংস্কৃতির কাছে বোধগম্য হওয়ার লক্ষ্যে পরিবর্তিত হয়ে ফিরে এসেছে।
হুয়ান রামোন হিমেনেথের অনুবাদের ভিত্তি রবীন্দ্রনাথের স্বকৃত ইংরেজি সংস্করণ। ইংরেজি ভাষা বোঝা এবং এ ভাষায় নিজেকে প্রকাশের ক্ষমতা থাকলেও জটিলতায় পূর্ণ এক অনুবাদকর্মের জন্য এ ভাষায় যে দখল থাকা দরকার, হিমেনেথের তা ছিল না। বাধাটি অলঙ্ঘ্য মনে হলেও এই বাধা তিনি তাঁর স্ত্রী ছেনোরিয়া কাম্প্রুবি আইমারের বদৌলতে ডিঙিয়ে যেতে পেরেছিলেন। হিমেনেথের জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি রবীন্দ্রনাথের কবিতার স্প্যানিশ অনুবাদের সময়ও এই নারী হয়ে উঠবেন প্রধান এবং অনিবার্য ব্যক্তিত্ব। আইমার পরিবার পুয়ের্তো রিকোর অধিবাসী। ছেনোরিয়ার ভাই হোসে ছিলেন নিউইয়র্কের প্রথম দিককার হিস্পানি পত্রিকাগুলোর মালিক-সাংবাদিকদের একজন।
ছেনোরিয়া পড়াশোনা করেছেন আমেরিকায়। স্প্যানিশ ও ইংরেজি ভাষায় তাঁর দখল ছিল পুরোমাত্রায়। এই ভাষাজ্ঞানই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল রবীন্দ্ররচনা তর্জমায়। প্রায় এক দশক আগে মাদ্রিদের ঐতিহাসিক মহাফেজখানায় প্রফেসর হাওয়ার্ড ইয়ং গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে ছেনোরিয়ার অনুবাদের ওপর ভিত্তি করে হুয়ান রামোন হিমেনেথ লেখাগুলোকে সূক্ষ্মতা দান করেছেন এবং সেগুলোর একটা চূড়ান্ত রূপ দাঁড় করিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের মতোই তাঁর অনুবাদগুলোও না ছিল আক্ষরিক, না মূলানুগ। ভারতীয় কবির কাব্যিক সারবত্তার সঙ্গে যোগাযোগের লক্ষ্যে কাব্যিক প্রকরণে এবং হিস্পানি মেজাজে ভাবানুবাদের জন্ম দিলেন। ইয়ং এই সিদ্ধান্তে আসেন, হিমেনেথ ও ছেনোবিয়া এক আন্দালুসীয় ঠাকুরের জন্ম দিয়েছেন।
নিজের বাণীর বার্তাবাহক রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিশ্বজনীন মহান কর্মবৃত্তির প্রতি বিশ্বস্ত। অন্যদিকে ছেনোরিয়া কাম্প্রুবি এবং হুয়ান রামোন হিমেনেথ হয়ে ওঠেন হিস্পানি ভাষায় তাঁর অনুকূল মুখপাত্র। এই মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত গাবরিয়েলা মিস্ত্রাল, পাবলো নেরুদা ও অক্তাবিহ পাসসহ প্রজন্মের পর প্রজন্মের লেখকদের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রবাহিত। পরবর্তী অনুবাদগুলোর উনুনে মূল বক্তব্য কেবল হারিয়েই যায়নি, বরং এক সন্দেহাতীত উপায়ে তা ফলপ্রসূ হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া এই ভাবনা আমাদের মুগ্ধ না করে পারে না যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসংখ্য কবিতা, প্রবন্ধ ও কথাসাহিত্য স্প্যনিশ-ভাষী পাঠকদের এখনো অজানা, সের্বান্তেসের ভাষায় এখনো তা কোনো এক অনুবাদকের অপেক্ষায় আছে।
মারিয়া এলেনা বাররেরা আগরওয়াল
স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ: রাজু আলাউদ্দিন
—————————-
মারিয়া এলেনা বাররেরা আগরওয়াল
মারিয়া এলেনা বাররেরা একুয়াদরের তরুণ প্রজন্মের লেখিকা। মেহিকো, একুয়াদরসহ লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় লেখেন। নামের শেষে যুক্ত আগরওয়াল শব্দটি তাঁর স্বামীর পদবি। স্প্যানিশ এবং ভারতীয় ভাষার বিভিন্ন লেখক তাঁর আগ্রহের বিষয়। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এই লেখাটি ছাড়াও ভারতীয় হিন্দি লেখিকা মহাদেবী ভার্মাকে নিয়ে তাঁর সর্বশেষ লেখাটি বেরিয়েছে লা অত্রা নামের এক স্প্যানিশ সাহিত্য পত্রিকায়। এ পর্যন্ত তাঁর দুটি বই বেরিয়েছে—হাল্কভাবে উঁকি দেওয়া গান বেরিয়েছিল ২০০২ সালে। এটি শিশুদের জন্য কবিতার বই। অন্যটি সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধের সংকলন শিখা ও প্রতিধ্বনি বেরিয়েছে ২০০৯ সালে।
মারিয়ার রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধটি বেরিয়েছিল মেহিকো থেকে প্রকাশিত লাতিন আমেরিকার নেতৃস্থানীয় সাহিত্য পত্রিকা লেত্রাস লিব্রের ২০০৪ সংখ্যায়। মেহিকোর বিখ্যাত ঐতিহাসিক, রাজনীতি-বিশ্লেষক ও সাহিত্য-সমালোচক এনিরকে ক্রাউসে এ পত্রিকাটি ১১ বছর ধরে সম্পাদনা করছেন। পত্রিকার নামটি মেহিকোর বিখ্যাত কবি অক্তাবিও পাসের দেওয়া। এ পত্রিকায় যাঁরা প্রায়ই লেখেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মারিও বার্গাস য়োসা, মিলান কুন্ডেরা, কার্লোস মনিসবাইস, এলেনা পোনিয়াতৌস্কা, এলিসেও আলবের্তো, হুয়ান গাইতিসোলো, নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত লো ক্লোজিও প্রমুখ।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ২৩, ২০১০
Leave a Reply