গ্রামের এক লোক তার ছেলের সঙ্গে জীবনে প্রথম এসেছে ঢাকায়। বাস থেকে গুলিস্তান নেমেই হাজার হাজার লোকের ভিড় দেখে তার ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার অবস্থা, ‘ও বাপ, আনলি তো আনলি হাটবারে কেন ঢাকায় আনলি?’ অত্যন্ত যৌক্তিক অনুযোগ। গ্রামের খোলা জল-হাওয়ার মানুষটাকে শুধু শুধু হাটবারে ঢাকায় এনে কষ্ট দেওয়ার কোনো অধিকার নেই ছেলের। তবে সেই আমলে হাটবার ছাড়া বাবাকে ঢাকায় নিয়ে আসাও একটা মুশকিলের ব্যাপার ছিল ছেলের পক্ষে। আর এখনকার কথা তো বাদই দিলাম। ঢাকা এখন সত্যি সত্যিই হাটের শহর। যেদিকে যাবেন, সেদিকেই হাট আর হাট। আর ঢাকার নাগরিকেরা সব হাটুরে। সেই হাট থেকে তারা কত কিছু কেনে!
শুক্রবার দিন কোট-টাই-শার্ট পরা লোকজন তাদের আদরের গাড়িটি ধুয়ে-মুছে রং করে নিয়ে আসে মানিক মিয়া এভিনিউতে। ক্রেতারা গাড়ি টিপেটুপে দেখে। সংসারে প্রথম গাড়ি। স্ত্রীকে নিয়ে স্বামী এসেছে গাড়ির হাটে। স্ত্রী বলল স্বামীকে, ‘এম্মা, এই গাড়ির রংটা কী বিচ্ছিরি! আর এই গাড়িটাই কিনা তুমি পছন্দ করলে!’ স্বামী হয়তো বা মৃদু স্বরে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে, ‘রং তো কোনো ফ্যাক্টর না, এই গাড়ির ইঞ্জিনটা ভালো।’ স্ত্রী বলবে, ‘ইঞ্জিন কি আর বাইরে থেকে দেখা যাবে নাকি! পাশের বাসার ভাবির গাড়ির রংটা কী সুন্দর বটল গ্রিন। আমি বটল গ্রিনের চেয়েও ভালো রং না হলে গাড়ি কিনবই না।’
হাটের ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই একটু বড়লোক কিসিমের, তাই তারা গুলিস্তান, ফার্মগেটের হকারদের মতো ‘খালি পাঁচ, খালি পাঁচ (লাখ), ভিভিটিআই ইঞ্জিন, আটানব্বই মডেল, সিএনজি করা, লইয়া যান, পানির দর’ সুর তোলে না। তারা গাড়ির একটা দাম ঝুলিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রানিক্ষেত রোগীর মতো ঝিমুতে থাকেন। ক্রেতা দেখলেই একটু নড়েচড়ে দাঁড়ান। এ রকম হাট ঢাকায় আছে বেশ কটি। অন্যদিকে যারা চার চাকার বদলে দুই চাকায় বিশ্বাসী, তাদের জন্য আছে আবার মোটরসাইকেলের হাট। চালিয়ে-টালিয়ে দেখেশুনে কেনার সুযোগ আছে সেগুলোয়।
তবে হাট বললেই ঢাকার মানুষের যে স্থানটির কথা প্রথমেই মনে হয়, তা গাবতলী—গরুর হাট। কোরবানি ঈদের আগে আগে মানুষ আর শুধু গাবতলীর ওপর ভরসা করতে পারবে না জেনে হাটকে বাড়ির কাছাকাছি নিয়ে আসে ব্যবসায়ীরা। ঈদ এগিয়ে আসতে থাকে, আর গরু-ছাগলের হাট পৌঁছে যায় অলিতে-গলিতে, বাসার দোরগোড়ায়। ঢাকা তখন এক আপাদমস্তক হাটের নগর।
আর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র তো আর সম্মেলন কেন্দ্র না, এটা এখন হাটেরই জায়গা। মেলা আর ফেস্টিভাল নাম দিয়ে কিসের হাট বসে না সেখানে—ঘরবাড়ি কেনার রিহ্যাব ফেয়ার, মেডি এক্সপো, টেক্সটাইল ফেয়ার, পর্যটন মেলা থেকে শুরু করে সবকিছুই এখানে বিভিন্ন সময় জমে ওঠে।
এত সব হাটের পাশাপাশি এবার একটা নতুন হাট বসানোর সময় বুঝি হয়েই এল। চ্যানেলের হাট। এই মুহূর্তে দেশে চ্যানেল আছে ১১টি। এর ভেতর কয়েকটির অবস্থা মুমূর্ষু। কয়েকটি ‘ওপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট’। একটি আবার মরে গিয়েও জেগে উঠে আবার মরমর। আরেকটি মৃত্যুর পর আর পুনর্জীবন পায়নি। এর মধ্যে দেশে আসছে আরও ১০টি নতুন টেলিভিশন চ্যানেল। চ্যানেলবহরে এগুলো যোগ হলে দেশে টিভি চ্যানেলের সংখ্যা দাঁড়াবে ২১টির মতো। এগুলোর মধ্যে লাইসেন্স পাওয়া অনেকেরই চ্যানেল চালানোর মতো টাকা নেই। কাজেই তারা তাদের লাইসেন্সের পসরা সাজিয়ে বসতে পারে চ্যানেলের হাটে। প্রতি শুক্রবার সেই হাটে চ্যানেলের মালিকেরা লাইসেন্স নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁকবে, ‘এই পানির দর, আর পাইবেন না কিন্না লন, কাগজপত্রের ঝামেলা নাই। চেক কইরা লন।’ কেউ হয়তো বা এসে বোকার মতো বলবে, ‘সবই তো ভাই স্যাটেলাইট। টেরিস্ট্রিয়াল নাই কারও কাছে?’ একজন পাশ থেকে বলবে, ‘টেরিস্ট্রিয়াল লাগবে? আসেন ভাই, আমার সঙ্গে। দাম কিন্তু একটু বেশি পড়ব।’ কেউ হয়তো বা তাকে সতর্ক করে দেবে, ‘ভাই, ওই টেরিস্ট্রিয়াল কিনেন না, ভেজাল আছে, কাগজপত্রে ঠিক নাই। চ্যানেল চালানোর কয়েক দিন পরই কিন্তু সরকার বন্ধ করে দিব।’
ক্রেতারা চ্যানেল লাইসেন্সের ব্যাপারে অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়ে মেলায় আসবে, আতশ কাচ দিয়ে লাইসেন্সের কাগজপত্র পরীক্ষা করবে, তারপর খুশি মনে কিনে নিয়ে যাবে বাড়ি। গিয়ে হয়তো বা বউকে বলবে, ‘চোখ বন্ধ! আজ না তোমার জন্মদিন! এই দেখো তোমার জন্য কী উপহার এনেছি!’ বউ চোখ খুলে হাতে চ্যানেলের কাগজপত্র দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠবে, ‘চ্যানেল, আমার জন্য!’
সিমু নাসের
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২৬, ২০০৯
Leave a Reply