গোপাল ভাঁড়ের গল্প চিরনবীন। কারণ বাঙালিজীবনে অসংগতি, পাগলামো, পরিমিতিবোধের অভাব, রঙ্গরসিকতা ইত্যাদি থাকবেই। আর গোপাল ভাঁড়ও তাই থাকবেন।
গোপাল ভাঁড়ের এই গল্পটা আপনারা জানেন। রাজা বললেন, শীতের রাতে কেউ কি সারা রাত এই পুকুরে গলাপানিতে ডুবে থাকতে পারবে? যদি কেউ পারে, আমি তাকে অনেক টাকাপয়সা, ধনরত্ন পুরস্কার দেব।
এক ছিল গরিব দুঃখী মানুষ। সে বলল, আমি পারব।
সে মাঘ মাসের তীব্র শীতে সারা রাত পুকুরের পানিতে গলা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ভোরের বেলা সে উঠল পানি থেকে।
রাজার কাছে গিয়ে সে বলল, আমি সারা রাত পুকুরের পানিতে ছিলাম। আপনার সান্ত্রী-সেপাই সাক্ষী। এবার আমার পুরস্কার দিন।
রাজা বললেন, সেকি, তুমি কেমন করে এটা পারলে!
গরিব লোকটা বলল, আমি পানিতে সারা রাত দাঁড়িয়ে রইলাম। দূরে, অনেক দূরে এক গৃহস্থবাড়িতে আলো জ্বলছে। আমি সেই দিকে তাকিয়ে রইলাম। সারা রাত কেটে গেল।
মন্ত্রী বলল, পাওয়া গেছে। এই যে দূরের প্রদীপের আলোর দিকে ও তাকিয়ে ছিল, ওই প্রদীপ থেকে তাপ এসে তার গায়ে লেগেছে। তাই তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে এই শীতেও ওই পুকুরে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে থাকা।
রাজা বললেন, তাই তো! তাহলে তো তুমি আর পুরস্কার পাও না। যাও। বিদায় হও।
গরিব লোকটা কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিল। সে গেল গোপাল ভাঁড়ের কাছে। অনুযোগ জানাল তাঁর কাছে। সব শুনলেন গোপাল ভাঁড়।
তারপর গোপাল ভাঁড় বললেন, ঠিক আছে, তুমি ন্যায়বিচার পাবে।
গোপাল ভাঁড় দাওয়াত করলেন রাজাকে। দুপুরে খাওয়াবেন। রাজা এলেন গোপাল ভাঁড়ের বাড়ি। গোপাল ভাঁড় বললেন, আসুন আসুন। আর সামান্যই আছে রান্নার বাকি। কী রাঁধছি দেখবেন, চলেন।
গোপাল ভাঁড় রাজাকে নিয়ে গেলেন বাড়ির পেছনে। সেখানে একটা তালগাছের ওপর একটা হাঁড়ি বাঁধা আর নিচে একটা কুপিবাতি জ্বালানো।
গোপাল ভাঁড় বললেন, ওই যে হাঁড়ি, ওটাতে পানি, চাল, ডাল, নুন সব দেওয়া আছে। এই তো খিচুড়ি হয়ে এল বলে। শিগগিরই আপনাদের গরম গরম খিচুড়ি খাওয়াচ্ছি।
রাজা বললেন, তোমার বাড়িতে দাওয়াত খাব বলে সকাল থেকে তেমন কিছু খাইনি। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। এখন এই রসিকতা ভালো লাগে!
রসিকতা কেন, রান্না হয়ে এল বলে।
রাজা বললেন, তোমার ওই খিচুড়ি জীবনেও হবে না, আমার আর খাওয়াও হবে না। চলো মন্ত্রী, ফিরে যাই।
গোপাল বললেন, মহারাজ, কেন খিচুড়ি হবে না। দূরে গৃহস্থবাড়িতে জ্বালানো প্রদীপের আলো যদি পুকুরের পানিতে ডুবে থাকা গরিব প্রজার গায়ে তাপ দিতে পারে, এই প্রদীপ তো হাঁড়ির অনেক কাছে। নিশ্চয়ই খিচুড়ি হবে।
রাজা তার ভুল বুঝতে পারলেন। বললেন, আচ্ছা পাঠিয়ে দিয়ো তোমার ওই গরিব প্রজাকে। ওর প্রতি আসলেই অন্যায় করা হয়েছে। ওকে ডাবল পুরস্কার দেব।
সে তো আপনি দেবেনই। আমি জানতাম। আসুন, ঘরে আসুন। দুপুরের খাওয়া প্রস্তুত।
তারপর রাজা সত্যি সত্যি গরিব লোকটাকে অনেক পুরস্কার দিয়েছিলেন।
আজকের দিনে গোপাল ভাঁড় শারীরিকভাবে নেই। কিন্তু তার রসিকতাগুলো রয়েই গেছে।
আগুন লাগানো বিষয়ে সম্প্রতি তেমনই একটা রসিকতা করা হয়েছে। এই রসিকতা শুনে দেশের মানুষ এমন অট্টহাসি দিয়েছে যে সবার মন ভালো হয়ে গেছে।
সংবাদপত্রে কোনো খবর প্রকাশিত হলে যে-কেউই রুষ্ট হতে পারেন। সব খবর সবার পক্ষে যাবে না। যে-কেউ যেকোনো খবরকে প্র্রতিবাদযোগ্য বলেও মনে করতে পারেন। খবর সত্য, নাকি মিথ্যা, এ সম্পর্কে মুখ না খুলে খবরের কাগজের সম্পাদক বা মালিকদের বিরুদ্ধে উল্টো অন্য অপ্রাসঙ্গিক অভিযোগ তোলা যে খুবই অভিনব একটা ঘটনা, সেটা সবাই স্বীকার করবেন। কিন্তু অভিযোগটা কী হবে, সেটা নিশ্চয়ই একটু ভেবে ঠিক করা দরকার ছিল।
এখন দেশের মানুষ বলাবলি করছে, ওই আলোচিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি বলেছিল, যাদের অফিস, তারাই তদন্তকাজে সহযোগিতা করেনি বলে ঘটনার কারণ উদ্ঘাটন করা যায়নি। কেঁচো খুঁড়তে কেউটে সাপ না বেরিয়ে যায়! অন্যের জন্য কুয়ো খুঁড়ে না সেই কুয়োতে উল্টো পড়ে যেতে হয়।
ওই ঘটনায় মানুষের মৃত্যুও হয়েছিল। যার বাড়ি, তার সহযোগিতার অভাবে তদন্ত করা যায়নি বলে দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ নেই। কারণ যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের জীবন তো ফিরিয়ে দিতে পারবে না কেউ। এখন দেশের মানুষ চায়, নিরপেক্ষ কিন্তু দক্ষ আইনানুগ কর্তৃপক্ষ ওই আলোচিত অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত করে। উদ্ঘাটন করুক আসলে কারা ঘটিয়েছিল ওই অগ্নিকাণ্ড। কেন ঘটিয়েছিল।
গোপাল ভাঁড়ের কাণ্ডকারখানার উদ্দেশ্য থাকত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। তার মাধ্যমে লোকে হাস্যরসও পেত, কিন্তু সেটা বাহ্য। এই আলোচিত অগ্নিসংযোগের অভিযোগ যথেষ্ট হাস্যরস সৃষ্টি করেছে, এবার দরকার ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ১৯, ২০০৯
Leave a Reply