বড় ভাই ঠিক করেছে বিয়ে করবে। অন্য পরিবারের একটা মেয়ে আমাদের পরিবারে আসবে, এসে দেখবে বাসায় কিছু নেই; রাত হলে মশারি টানিয়ে সবাই ফ্লোরে ঘুমিয়ে যায়—বিষয়টা নিয়ে তাকে খানিকটা চিন্তিত মনে হলো। কীভাবে কীভাবে কিছু টাকা জোগাড় করে একদিন বিকেলে আমাকে বলল, ‘চল, বাসার জন্য একটা দুইটা ফার্নিচার কিনে আনি।’
আমরা নিউমার্কেট এলাকায় গিয়েছি। খুঁজে খুঁজে ফার্নিচারের দোকানে গিয়ে ফার্নিচারের দাম দেখে একেবারে আক্কেল-গুড়ুম। কাঠের ফার্নিচারের যে এত দাম হতে পারে সেটা আমরা কোনো দিন কল্পনাও করিনি! দাম শুনে মনে হলো এগুলো কাঠ নয়, সব ফার্নিচার বুঝি সোনা দিয়ে বানিয়েছে। কয়েকটা ফার্নিচারের দোকানে হাঁটাহাঁটি করেই আমরা বুঝে গেলাম যে আমাদের পক্ষে ফার্নিচার কেনা দূরে থাকুক, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখারই ক্ষমতা নেই। বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ একটু বিমর্ষ হয়ে গেল।
আমি বললাম, ‘এক কাজ করলে কেমন হয়?’
‘কী কাজ?’
‘চল কিছু কাঠ কিনে নিয়ে যাই। তার সঙ্গে করাত, হাতুড়ি, বাটাল এবং র্যাদ। নিজেরা ফার্নিচার বানিয়ে নেব।’
‘পারবি?’
‘না পারার কী আছে?’ ঠিক কী কারণ জানি না, কখনোই কোনো কাজ আমার কঠিন মনে হয় না। আমি জোর দিয়ে বললাম, ‘ভালো একটা ডিজাইন দেখে ফার্নিচার বানিয়ে নেব।’
বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদের আইডিয়াটা পছন্দ হলো। হিসাব করে দেখা গেল যত টাকা নিয়ে এসেছি সেটা দিয়ে করাত, হাতুড়ি, বাটাল, র্যাদ আর কিছু কাঠ কিনে নেওয়া সম্ভব।
কাজেই সন্ধেবেলা আমরা দুই ভাই রিকশা করে কিছু কাঠের তক্তা, করাত, হাতুড়ি, বাটাল ও র্যাদ নিয়ে হাজির হলাম। বলা বাহুল্য, বাসার লোকজন ফার্নিচার কিনে না এনে ফার্নিচার তৈরির কাঁচামাল কিনে আনা দেখে এমন কিছু অবাক হলো না।
সন্ধেবেলা সবার সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করা হলো কী কী ফার্নিচার তৈরি করা যায়। একজন বলল, সোফা সেট, একজন বলল ডাইনিং সেট। বড় বোন বলল, তার বেশি কিছু চাই না, হারমোনিয়ামটা রাখার জন্য একটা বাক্স তৈরি করে দিলেই হবে। আমরা বললাম ‘তথাস্তু!’
রাত্রিবেলা খেয়ে ছাদে ইলেকট্রিক লাইট লাগিয়ে কাজ শুরু করে দিলাম। কাঠমিস্ত্রিদের কাজ করতে দেখেছি, করাত দিয়ে কী সুন্দর ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে কাঠ কেটে ফেলে, এই কাজটার মধ্যে কোনো পরিশ্রম আছে সেটা ধারণাও করিনি। কিন্তু কাঠগুলো কাটতে গিয়েই আমাদের কালো ঘাম ছুটে গেল, খুব অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম কাঠ কাটা খুব পরিশ্রমের কাজ। কাজেই প্রথমে কোন ফার্নিচার বানানো হবে সেটা একটু পরিবর্তন করতে হলো। ঠিক করা হলো সোফা সেট কিংবা ডাইনিং টেবিল তৈরি না করে প্রথমে একটা সহজ জিনিস তৈরি করা হবে। সেটা হচ্ছে বুক শেলফ।
কাগজে ডিজাইন করে অনেক কষ্ট করে কাঠ কেটেছি। এখন র্যাদ দিয়ে সেগুলো পালিশ করার কথা। সবসময়ই দেখে এসেছি, র্যাদ চালানোর সময় কাঠের পাতলা ছিলকে বের হয়ে আসে, ভারি সুন্দর একটা দৃশ্য। মহা উত্সাহে র্যাদ চালিয়ে কাঠ পালিশ করে যাচ্ছি এবং প্রতি ঘষাতে একটা করে ছিলকে বের হয়ে আসছে, সত্যি সত্যি সুন্দর একটা দৃশ্য—তবে ভারি পরিশ্রম। তক্তার এক পাশ পালিশ করতেই কালো ঘাম বের হয়ে গেল। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ তার ফার্নিচার বানানোর প্রজেক্টে ইস্তফা দিয়ে নিচে চলে গেল। আমি হাল ছেড়ে দিলাম না। আমার সমবয়সী এক মামাকে নিয়ে প্রায় সারা রাত পরিশ্রম করে কাঠের তক্তাগুলো পালিশ করে ফেললাম।
পরের দিন উঠে দেখি পালিশ করা তক্তাগুলো বাঁকা হয়ে আছে। কাঠমিস্ত্রি না হওয়ার কারণে কাঠ সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা নেই, সেগুলো সম্ভবত ভেজা ছিল এবং যতই শুকাতে লাগল ততই বাঁকা হতে লাগল। প্রতিদিন আমরা পালিশ করে সোজা করে রাখি, ভোরবেলা আবিষ্কার করি সেটা বাঁকা হয়ে আছে! শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে সেই বাঁকা তক্তাগুলোয় পেরেক দিয়ে পিটিয়ে একটার সঙ্গে আরেকটা লাগিয়ে বুক শেলফটাকে দাঁড়া করানো হলো। কী রং দেওয়া হবে সেটা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে কুচকুচে কালো রং করে ফেলা হলো। রং শুকিয়ে গেলে সেটাকে ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখা হলো। বই দিয়ে সাজিয়ে রাখার পর সেটাকে রীতিমতো সত্যিকার শেলফের মতো দেখাতে লাগল।
বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদের বিয়ের পর যখন ভাবি আমাদের বাসায় এসেছিল তখন অনেক পরিশ্রম করে তৈরি করা এই বুক শেলফটি ছাড়া নতুন কোনো ফার্নিচার আসেনি। ভাবি খুব অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে ছিল কিন্তু আমাদের এই নেহাত সাদামাটা অবস্থায় মানিয়ে নিতে তার কোনোই সমস্যা হয়নি।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক। জন্ম ২৩, ডিসেম্বর ১৯৫২। এ লেখাটি তাঁর রঙিন চশমা বই থেকে সংগৃহীত
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ১৯, ২০০৯
Leave a Reply