মান্যবর অতিথিবৃন্দ, আপনাদের সবাইকে কালো ধোঁয়া ও ট্রাফিক পুলিশমুক্ত একরাশ নির্মল পরিবেশের শুভেচ্ছা। আপনারা জানেন, ঢাকার রাস্তায় আমাদের সঙ্গে দৌড়ানোর জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশনের অনুমোদন পেয়েছেন জনাব সিটি বাইক। তার সম্মানার্থে আজকের এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন। প্রথমেই সিটি বাইক আপনাদের সবার উদ্দেশে কিছু বলবেন।
সিটি বাইক: ধন্যবাদ। ঢাকার রাস্তায় নেমেই আমি দেখলাম, এখানে চলাচলের কোনো জায়গা নেই। আমার মতে, প্রথমেই ঢাকার রাস্তা থেকে সব রিকশা ঝেঁটিয়ে বিদায় করা উচিত।
রিকশা: এটা কী ধরনের কথা বললেন? আসতে না আসতেই আমার সঙ্গে শত্রুতা! আপনি যা বললেন, আমি তার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। তার চেয়ে বড় কথা, শত বছরের কাছাকাছি হয়ে গেল আমি ঢাকার রাস্তায় আছি, অথচ আমার সম্মানে কোনো বৈঠক হলো না। আর সেদিনকার কোন পুঁচকে ছোকরা সিটি বাইক, তার জন্য হচ্ছে কিনা গোলটেবিল বৈঠক!
সিএনজি: এটা কিন্তু ঠিক কথা বললা না, রিকশা ভাই। তুমি যে আমলে রাস্তায় নেমেছ, সে আমলে টেবিল শুধু চারকোনাই হতো। সুতরাং তোমাকে নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক হওয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। তা ছাড়া তোমার সম্মান এমনিতেও কম না। প্রায়ই দেখি, পুলিশরা তোমাকে ট্রাক ভাইয়ের ওপর চড়িয়ে ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী ট্রাক ভাই, সত্যি কি না বলো?
রিকশা: পুলিশরা আমাকে ট্রাকে উঠিয়ে ঢাকা ভ্রমণ করায় না, ট্রাকে উঠিয়ে ওরা আমাদের ধরে নিয়ে যায়।
ভলভো: আমার মতো মহান দোতলা বাসেরই কোনো সম্মান নাই, আর তুমি আসছ রিকশার সম্মান নিয়ে কথা বলতে! তোমরা ভাবতে পার, এই মহান ভলভোকে রিকশা-টেম্পো-ট্যাক্সির সঙ্গে রাস্তার সিগনালে দাঁড়াতে হয়! এই মহান ভলভোর জন্য কোনো প্রাইভেট রাস্তা নাই! কী বিচিত্র এই দেশ, সেলুকাস!
নসিমন: এত মহান মহান করেন কেন? আমরা কি আপনার চেয়ে কম মহান নাকি?
ভলভো: মহান! তাও আবার তোমরা! কী আছে তোমাদের? ঢাকা শহরে একমাত্র আমার জন্য কম্পিউটারাইজড টিকিট কাটিং ব্যবস্থা আছে, তোমাদের আছে? তা ছাড়া আমার চাকা আটটা, আর কার এতগুলো চাকা আছে, শুনি।
নসিমন: খালি ট্রেন ভাই যদি আজকের মিটিংয়ে আসত তাহলে দেখতাম, চাক্কার এই অহংকার কোথায় যায়! ভালো কথা, মিটিংয়ে দেখছি ট্রাক ভাইও আছেন। আপনার তো রাত ১০টার পরে ঢাকা শহরে ঢোকার কথা, কিন্তু আমাদের এই বিকেলের মিটিংয়ে আসলেন কীভাবে?
ট্রাক: ভালো প্রশ্ন করেছ। আমার এখানে আসতে ২০০ খরচ করতে হয়েছে। এখন তোমরা চাঁদা তুলে আমাকে টাকা ২০০ ফেরত দিবা।
নসিমন: না, না, আমি কোনো টাকা-পয়সা দিতে পারব না। আমার ইনকাম অনেক কম। তবে আমাদের হয়ে আমাদের সবার বড় ভাই সুইডিশ নাগরিক ভলভো ভাই সবার টাকা পরিশোধ করবেন।
ভলভো: শোনো নসিমন মিয়া, তোমার কিন্তু লাইসেন্স নাই, কথাবার্তা সাবধানে বলো। আমি সরকারি লোক আর তুমি কিনা আমার কাছে টাকা চাও! আমার কাছে তো ট্রাফিকও টাকা চায় না। আমি কোনো টাকা-পয়সা দিতে পারব না।
ট্রাক: থাক, আমাকে তোমাদের টাকা-পয়সা দিতে হবে না; তোমরা ঝগড়াঝাঁটি, তর্ক-বিতর্ক বন্ধ করো। এসব আমার বিশেষ পছন্দ না।
টেম্পো: হিঃ হিঃ হিঃ, শুনলেন ট্রাক ভাইয়ের কথা, তার নাকি ঝগড়াঝাঁটি, তর্ক-বিতর্ক পছন্দ না। অথচ যখনই কোনো এক্সিডেন্টের খবর শুনি, তখন খোঁজ নিলে দেখা যায়, ট্রাক-বাস নয়তো ট্রাক-টেম্পো না হলে ট্রাক-নসিমন আর তা না হলে ট্রাকের সঙ্গে অন্য কেউ আছে। ঝগড়াঝাঁটি পছন্দ হয় না, অথচ এক্সিডেন্ট করতে তোমার বিশেষ পছন্দ হয়, তাই না!
ট্রাক: না মানে, প্রথম দিনেই সিটি বাইক সাহেবকে ভয় পাইয়ে দিতে চাচ্ছিলাম না। তাই একটু ভালো ভালো কথা বলে ওনার মনে সাহস জোগাবার প্রয়াসে…
সিটি বাইক: সবাইকে ধন্যবাদ। আপনাদের জেনে ভালো লাগবে যে আমার মনে সাহসের কোনো অভাব নাই। সাহস না থাকলে ঢাকার মতো এমন জ্যামের শহরে দৌড়াতে আসতাম না। তবে একটু অবাক লাগছে এই ভেবে যে রাস্তার যানবাহনদের বৈঠকে নৌকা সাহেব উপস্থিত হলেন কী মনে করে?
নৌকা: আপনি ঢাকা শহরে নতুন এসেছেন তো, তাই আপনার জানা নেই। আসলে মাঝে মাঝে ঢাকার রাস্তায় আমি নিজেও সার্ভিস দিই। বর্ষাকালে আমি ছাড়া এখানে উপস্থিত অন্য কোনো ব্রাদার তো থাকেনই না, হিঃ হিঃ হিঃ…
সিটি বাইক: বাহ! বেশ তো, তাহলে বর্ষাকালে আপনার সঙ্গে আবার আমার দেখা হবে?
সিএনজি: নৌকা ভাই, বর্ষাকালে সিটি বাইকের সঙ্গে দেখা করো সমস্যা নাই, তবে একটু দূরে দূরে থেকো। কারণ, সিটি বাইক সাহেব ব্যাটারিতে চলে। বর্ষার পানি যদি সিটি বাইক সাহেবের ব্যাটারিতে ঢোকে, আর তখন যদি তুমি তার কাছে থাকো, তাহলে শক খাবার চান্স থাকবে কিন্তু।
টেম্পো: তুমি এই সামান্য বিষয় নিয়ে ভাবছ, সিএনজি ভাই? আমি কিন্তু ভাবছি অন্য কিছু নিয়ে। তেলের দাম বাড়লে তুমিও ভাড়া বাড়াও, আমিও বাড়াই, আবার গ্যাসের দাম বাড়লে আমিও ভাড়া বাড়াই, তুমিও ভাড়া বাড়াও। কিন্তু সিটি বাইক ভাই কখন ভাড়া বাড়াবে, ভেবেই পাচ্ছি না?
সিটি বাইক: কেন, আমি তো ব্যাটারিতে চলি, যখন বিদ্যুতের বিল বাড়বে, তখন আমি ভাড়া বাড়াব।
টেম্পো: ও, তাই নাকি? তাহলে তো দেখছি, ভাড়া বাড়ানোর আরও একটা সুযোগ পাওয়া গেল। বিদ্যুতের দাম বাড়লে যখন সিটি বাইক ভাই ভাড়া বাড়াবে, তখন আমরাও ভাড়া বাড়াব।
রিকশা: তাহলে আমার কী হবে, আমি কখন ভাড়া বাড়াব? আমার তো পেট আছে নাকি?
ট্যাক্সি: যখন আলু-পটলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়বে, তখন তুমি ভাড়া বাড়াবা।
রিকশা: তাহলে এখন তো চিনির দাম তুঙ্গে, এখনই ভাড়াটা বাড়িয়ে দিই। কী বলেন, সিটি বাইক ভাই?
সিটি বাইক: তোমাদের যার যা ইচ্ছা, করো। আমি এতক্ষণ চার্জ দিচ্ছিলাম। আমার চার্জ ফুল হয়ে গেছে, যাই বাইরে গিয়ে ট্রিপ মেরে আসি।
মেহেদী আল মাহমুদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ১৯, ২০০৯
Leave a Reply