আবারও সেরা ধনী হয়েছেন বিল গেটস। তিনি নাকি সেকেন্ডে আয় করেন তিন হাজার ডলার। মানিব্যাগ থেকে এক হাজার ডলারের নোট পড়ে গেলে তিনি নাকি তা আবার পকেটস্থ করেন না। কারণ তাতে যে সময় চলে যায় সেই একই সময়ে তিনি তার চেয়ে বেশি আয় করেন। বিল গেটসের একার যে সম্পদ, বিশ্বের ১৪০টি দেশের এক বছরের আয় তার চেয়ে কম। এই অক্টোবর মাসেই সংবাদটা ছাপা হয়। তার পরই জুলমত তরফদারের মাথায় ধনী মানুষেরা মোটামুটি গেঁথে গেল।
ছোটবেলায় পড়েছিলেন, অর্থই অনর্থের মূল। এখন আর এসব কথা বিশ্বাস করেন না। এটা ঠিক যে দুনিয়ায় অর্থ ছাড়া আরও অনেক লোভনীয়, মোহনীয়, রসাল জিনিস আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সেসব জিনিসও কিনতে হয় অর্থ দিয়েই।
ধনী হওয়ার নানা তরিকা আছে। টাকা ধার নিয়ে বেমালুম ভুলে যাওয়া একটা বড় তরিকা। বাংলাদেশে একসময় এটাই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয় পন্থা। তবে নিয়ম হচ্ছে, অল্প টাকা ঋণ নিলে চলবে না। নিতে হবে বড় অঙ্কের অর্থ। কেউ যদি ১০০ টাকা ধার নেয়, তাহলে সেটা একান্তই তার সমস্যা। কিন্তু ব্যাংক থেকে ১০০ কোটি টাকা ধার নিলে সেটা তখন ব্যাংকের সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এই সমস্যা থেকে অনেক ব্যাংক এখনো বের হতে পারেনি। আর এই সমস্যাকবলিত ব্যাংকের ঘাড়ে পা দিয়ে কোটিপতি হওয়ার সংখ্যা বাংলাদেশে মোটেই কম নয়।
জুলমত তরফদারের বন্ধু সালেম মিয়া, একজন সফল ব্যক্তি। কারণ সালেম মিয়া দুই হাতে টাকা আয় করে। তবে জুলমত জানে, সালেম মিয়ার চেয়ে সফল ব্যক্তি এই দেশে আছে। এই যেমন মিসেস সালেম। সে বিয়ে করার জন্য সালেম মিয়াকে খুঁজে বের করতে পেরেছিল।
সালেম মিয়ার বউয়ের কথাই যখন এল, তখন জুলমত তরফদারের সেই পুরোনো গল্পটা মনে পড়ল। একজন মহিলা কি কোনো পুরুষকে লাখপতি বানাতে পারে? উত্তরটা হলো—পারে, যদি পুরুষটি কোটিপতি হয়।
পরিস্থিতি আর আগের মতো নেই। বরং উল্টোটা আছে। গজনফর আলী একজন কোটিপতি। সদ্য একটি চেম্বারের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছে। সাংবাদিকেরা গেছে সাক্ষাত্কার নিতে। নানা প্রশ্ন। একজন প্রশ্ন করল, ‘আমরা জেনেছি যে আপনি শূন্য হাতে একটা মফস্বল শহর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। তাহলে আপনার কোটিপতি হওয়ার রহস্য কী।’
গজনফর আলী: আমার পকেটে ছিল মাত্র ১০ টাকা। আজ থেকে ৩০ বছর আগের ঘটনা। আমি সেই ১০ টাকা দিয়ে চারটা আপেল কিনেছিলাম। সেই আপেল কলের পানি দিয়ে ধুয়ে চকচকা করে বিক্রি করি ১২ টাকায়। দুই টাকা লাভ হয়েছিল।
সাংবাদিক: তারপর?
গজনফর আলী: ১২ টাকা দিয়ে আমি আবার চারটি আপেল কিনি। সেই আপেল পরিষ্কার আর চকচকে করে বিক্রি করি ১৫ টাকায়। সেই ১৫ টাকা দিয়ে ছয়টি আপেল কিনে বিক্রি করে পাই ২০ টাকা।
সাংবাদিক: তারপর?
গজনফর আলী: এভাবে প্রথম মাস শেষে আমার লাভ হয় ৪০ টাকা।
সাংবাদিক: তারপর কী হলো? এভাবেই কোটিপতি হয়ে গেলেন?
গজনফর আলী: আরে না। এভাবে কি আর কোটিপতি হওয়া যায়! তার পরই তো আমার স্ত্রীর বাবা মানে আমার শ্বশুর মারা গেলেন। আর আমি তাঁর কয়েক কোটি টাকার পুরো সম্পত্তি পেয়ে গেলাম।
জুলমত তরফদার জানে, এই যুগে আজকাল সবাই প্রায় এই পথেই বড়লোক হয়েছে। শ্বশুরের সম্পত্তি অবশ্য সবচেয়ে বেশি পায় সরকারি আমলারা। বেতন যা-ই পাক, ঢাকায় অনেকেই একাধিক গাড়ি-বাড়ি-ফ্ল্যাটের মালিক। ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা। যখনই কেউ ধরা পড়ে, জানা যায়, সবই শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি, বউয়ের নামে রাখা।
জুলমতের বন্ধু সোলায়মান মৃধা বাড়াবাড়ি ধরনের বড়লোক। কত টাকা আছে তা সে নিজেও জানে না। নিজের কত টাকা আছে তা যে জানে সে নাকি আর ধনীর সংজ্ঞায় পড়ে না। কিন্তু একসময় এই সোলায়মান মৃধাও ফেঁসে গেল এক মামলায়। জেল থেকে বাঁচতে গেল শহরের নামী একজন আইনজীবীর কাছে।
সোলায়মান মৃধা: আমি জেলে যেতে চাই না।
আইনজীবী: কেন জেলে যেতে চান না? অপরাধ করলে তো শাস্তি পেতেই হবে।
সোলায়মান মৃধা: আমার অনেক টাকা। আমি জীবনকে এখনো উপভোগ করতে চাই। তা ছাড়া আমি জানি ধনীরা কখনো জেলে যায় না।
আইনজীবী: ঠিক আছে। আমি ব্যবস্থা করছি। আসলেই ধনীরা কখনো জেলে যায় না। আপনি বাসায় যান।
কথা রেখেছিল আইনজীবী। সোলায়মান মৃধা পাঁচ বছর মামলা চলার পর যখন জেলে গেল, তখন সে আর ধনী ছিল না। এখন সেই আইনজীবী নিজেই দেশের সবচেয়ে ধনীদের একজন।
শওকত হোসেন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ১৯, ২০০৯
Leave a Reply