লেখক গজপতি চোঙদার লেখেন বরাহমিহির ছদ্মনামে। এ ছদ্মনাম নেওয়ার ব্যাপারে তাঁর বন্ধু বঙ্গবিহারি বাবুর একটা ভূমিকা আছে।
সে আজ বেশ কয়েক বছর আগের কথা। গজপতি সেই সবে গল্প লেখা শুরু করেছেন। নানা পত্রিকায় গল্প পাঠান। কিন্তু কিছুদিন পরেই সম্পাদকের তরফ থেকে একটি করে চিঠি আসে, ‘আপনার পাঠানো গল্প মনোনীত হয়নি। দুঃখিত।’
গজপতি চোঙদার মুষড়ে পড়েন।
গজপতিকে গল্প লেখাও ধরিয়েছেন তাঁর ব্যবসাদার বন্ধু বঙ্গবিহারি বাবু। তা না হলে তিনি আগে ছড়া লিখতেন। ব্যবসাদার বঙ্গবিহারি বাবু বলেছিলেন, দেখ গজপতি, ছড়া লিখে কোটিপতি হওয়া তো দূরের কথা, হাজারপতি হওয়াটাও দুঃসাধ্য ব্যাপার। পারিস তো ছড়া-ফড়া ছেড়ে গল্প-উপন্যাস লেখ। কোনো রকমে যদি ওই স্বদেশ কিংবা বহুবাজার পত্রিকায় ঢুকে পড়তে পারিস, তা হলে আর দেখতে হবে না। শুনেছি, ভালো টাকা-পয়সা ছাড়ে ওরা।
তো সে যা-ই হোক, বঙ্গবিহারি বাবুর পরামর্শ মতোই গজপতির গল্প লেখা। কিন্তু কোথাও ছাপা না হওয়ায় বঙ্গবিহারি বললেন, দেখ, আমার মনে হয়, তোর ওই নামটার জন্য সম্পাদকেরা কেউ তোর লেখা পড়ে দেখছেন না। লেখক-মানুষের নাম বেশ মিষ্টি-মিষ্টি, নরম হওয়া দরকার। কিন্তু তোর নামটা কেমন যেন। গজপতি বলে, দেখ, এ নাম আমার বাবা খুব শখ করে রেখেছিলেন। সেটা পাল্টানো কি ঠিক হবে? একটা ছদ্মনাম বেছে নিলে কেমন হয়?
বঙ্গবিহারি বাবু বললেন, দি আইডিয়া! তাই ঠিক কর।
গজপতি ভেবে-চিন্তে ছদ্মনাম নিলেন বরাহমিহির। এবার ওই আগের গল্পগুলোই নাম পাল্টে বরাহমিহির ছদ্মনামে আবার পাঠালেন। আবার অপেক্ষা। এবার তিন মাসের মধ্যেই খবর এল। সম্পাদকদের সেই এক ভাষায় জবাব, ‘আপনার পাঠানো গল্প মনোনীত হয়নি। আমরা দুঃখিত।’
ঠিক এ সময় গজপতি ওই বহুবাজার পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন দেখলেন। তাতে লেখা—‘নবীন-প্রবীণ লেখদের লেখায় গল্প সংকলন প্রকাশের পথে। যোগদানেচ্ছু লেখকেরা অবিলম্বে গল্প পাঠান।’ গজপতি দেরি করলেন না। পাঠিয়ে দিলেন ছদ্মনামেই একটা গল্প। কয়েক দিন পরই দপ্তর থেকে চিঠি এল, ‘আপনার গল্প মনোনীত হয়েছে। সংক্ষিপ্ত জীবনীসহ এক কপি ফোটো পাঠান। আর মানিঅর্ডারে ২০০ টাকা।’
গজপতি গৃহিণীকে কিচ্ছুটি না বলে গঞ্জে একটা স্টুডিওতে গিয়ে হাসি হাসি মুখে ফোটো তোলালেন। জীবনী লিখলেন। তারপর টাকাসহ পাঠিয়ে দিলেন।
বন্ধু বঙ্গবিহারি তা শুনে বললেন, তুই সত্যিই বরাহ। টাকা-পাঠানোর আগে আমাকে বললি না? তোর ওই টাকা পাঠানোই সার হলো। ওই সংকলন কোনো দিনই বের হবে না। বেচারা গজপতি তা শুনে নেতিয়ে পড়লেন।
গজপতি গল্পের গোয়াল নামের একটি পত্রিকাতেও লেখা পাঠিয়েছিলেন। সেখান থেকে সম্পাদকের চিঠি এল। তাতে লেখা—‘আপনাকে আমাদের পত্রিকার গ্রাহক হইতে হইবে। তা ছাড়া কমপক্ষে ১৫ জন গ্রাহক সংগ্রহ করিয়া দিলে প্রতি সংখ্যায় আপনার গল্প প্রকাশ করিতে পারি।’ গজপতি চেনা-জানা আত্মীয়-স্বজনদের নাম-ঠিকানা দিয়ে নিজের পকেট থেকে ১৫ জন গ্রাহকের টাকা গল্পের গোয়াল পত্রিকার সম্পাদকের নামে পাঠিয়ে দিলেন। বঙ্গবিহারি বাবুকে জানালেন না।
এরপর কেটে যায় ছয় মাস। ছয় মাসে ছয়টি গল্প পর পর ছাপা হওয়ার পর বন্ধু বঙ্গবিহারি বাবুকে সেগুলো দেখালেন। তিনি সেগুলো দেখে বললেন, এবার তোর কপাল খোলার মুখে। এ সময় যদি ওই গল্পের গোয়াল পত্রিকার ১০-২০ জন পাঠক ওই বহুবাজার পত্রিকার সম্পাদককে তোর নাম উল্লেখ করে চিঠি দেয় তো বেশ হয়।
গজপতি ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে না পারায় বঙ্গবন্ধু বাবু বললেন, কী রে, বুঝলি না? শোন বলি। বেশ কিছু পাঠক যদি ওই বহুবাজার পত্রিকায় চিঠি লিখে জানায় যে গল্পের গোয়াল পত্রিকায় মিহির ছদ্মনামের লেখক দুর্দান্ত লিখিতেছে। আমরা তাঁহার গল্প আপনার পত্রিকাতেও পড়িতে চাহি। ব্যস, তাহলে তিনি বুঝবেন, তুই দারুণ দারুণ সব গল্প লিখছিস। আর তখন যদি তিনি তোর লেখা পান, তাহলে জনমতের চাপে তোর লেখা ছাপা হতে পারে।
এমন এক স্বাস্থ্যবান পরামর্শে গজপতির ছোট কুতকুতে চোখও বেশ বড় হয়ে উঠল। বঙ্গবিহারি বাবুর বুদ্ধির তারিফ জানিয়ে তিনি বললেন, সত্যি, তোর জুড়ি মেলা ভার।
গজপতি ২০ খানা পোস্টকার্ড সংগ্রহ করলেন। একটি কাগজে লিখলেন, ‘মাননীয় সম্পাদক, বহুবাজার পত্রিকা সমীপেষু, মহাশয়, গল্পের গোয়াল পত্রিকার লেখক বরাহমিহিরের গল্পের তুলনা নেই। তাঁর লেখা গল্প আপনার পত্রিকাতেও পড়িতে চাই। আশা করি, লেখকের সহিত যোগাযোগ করিবেন।’ গজপতি লেখা কাগজ সমেত ২০ খানা পোস্টকার্ড ছেলেদের আড্ডায় দিয়ে বললেন, তোমরা এ বয়ানটা হুবহু না লিখে নিজের নিজের ভাষায় এ পোস্টকার্ডগুলোয় লিখে দাও তো ভাই। চিঠিতে যে যার নাম লিখে ঠিকানার জায়গায় বর্ধমান, হুগলি, নদীয়া জেলার নাম উল্লেখ করে যা হোক একটা গ্রাম-শহরের নাম লিখে দিও। আর এই নাও বহুবাজার পত্রিকার ঠিকানা। এ ঠিকানায়ই তোমাদের চিঠিগুলো যাবে। কথা দিলাম, কাজে লাগলে একদিন ভালো করে মিষ্টি খাইয়ে দেব।
মিষ্টি খাওয়ানোর কথা শুনে সেদিনই ছেলেরা উঠেপড়ে লেগে পড়ল। কী লিখতে কী লিখে ফেলবে, এ ভাবনায় ওরা আর নতুন করে কিছু না লিখে গজপতির বয়ানটাই অবিকল লিখে দিল। তারপর যে যার পোস্টকার্ডে কাল্পনিক ঠিকানা লিখে পরের দিন নিজেরাই হই-হই করে চিঠিগুলো গ্রামের ডাকবাক্সে গলিয়ে দিয়ে এল।
বঙ্গবিহারির কথামতো দিন ১৫ বাদে গজপতি বহুবাজার পত্রিকার সম্পাদকের ঘরে গিয়ে হাজির। বরাহমিহির নামটা শুনেই উনি বললেন, ও হো, আপনিই তো গল্পের গোয়াল পত্রিকার লেখক? আপনার গল্পের সুনাম করে অনেক চিঠি পেলাম। বিভিন্ন জেলার পাঠকেরা চিঠি লিখেছেন।
গজপতি এ ব্যাপারে কিছু না জানার ভান করে বললেন, তাই নাকি, স্যার? কী লিখেছেন ওনারা? লিখেছেন ভালো কথাই। কিন্তু ভেবে অবাক হচ্ছি, মেদিনীপুরের পত্রলেখক যে ভাষায় চিঠি লিখে আপনার গল্প ছাপার অনুরোধ জানিয়েছেন, সেই একই ভাষায় লিখেছেন হুগলি, বর্ধমান, বাঁকুড়ার পত্রলেখকেরাও। এ কী করে সম্ভব হলো বলুন তো?
গজপতির সুন্দর জবাব। সব মানুষেরই ইচ্ছার ভাষা এক স্যার। হয়তো সেজন্য।
হ্যাঁ, তা না হয় হলো। কিন্তু বরাহমিহির বাবু, আরও আশ্চর্যের ব্যাপারটা কি জানেন? একমাত্র বর্ধমান জেলার নারানপুর ছাড়া বাকি জেলাগুলোতে কোনো ডাকঘর নেই। সবাই যে যার চিঠি ফেলে গেছে বর্ধমানের নারানপুর ডাকঘরে। সব চিঠিতেই ওই ডাকঘরের সিল-মোহর। শুধু তাই-ই নয়। সব কটা চিঠির সিল-মোহরে একই তারিখ। এটা কী করে সম্ভব বলুন দেখি?
বরাহমিহির ছদ্মনামের আড়ালে গল্পের গোয়াল পত্রিকার নিয়মিত লেখক গজপতির এবার আর কোনো জবাব এসে জোগায় না। বুঝতে পারলেন, চালাকি করতে গেলেও বুদ্ধি লাগে অনেকটা। আসল জায়গাটিতেই চালে ভুল হয়ে গেছে। তিনি আর কোনো কথা না বলে গুটি-গুটি পায়ে বহুবাজার পত্রিকার সম্পাদকের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। ধরা পড়ার লজ্জায় ‘আচ্ছা আসি, নমস্কার’ কথাটিও বলতে ভুলে গেলেন। জানি না, এরপর বন্ধু বঙ্গবিহারির সঙ্গে দেখা হতে তিনি সব শুনে ওঁকে বরাহ বলে ডেকেছিলেন কি না।
সুনীতি মুখোপাধ্যায়: ভারতীয় লেখক।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ১২, ২০০৯
Leave a Reply