মামার বাসায় ঢুকে দেখি, একেবারে হুলস্থুল কাণ্ড। উত্সব উত্সব ভাব। আমাকে দেখেই মামি বললেন, এতক্ষণ লাগে আসতে? বাসায় কী করিস? মাকে রান্নাবান্নায় হেল্প করিস নাকি? আমি কিছু বললাম না। মামির চেহারা সুন্দর, রান্না তো অসাধারণ! কিন্তু সমস্যা হলো, খোঁচা না দিয়ে কোনো কথাই বলতে পারেন না। এত দিন পর দেখা হলো, কোথায় ভালো ভালো খাবার খেতে দেবেন তা না…ধ্যাত্! ভালোই লাগে না। সোফায় বসেই আমি ঝানু গোয়েন্দার মতো পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। সামনে তিন বছরের মামাতো বোন তানিশা। যেকোনো সময় অ্যাটাক হতে পারি। কোনো এক বিচিত্র কারণে আমার চেয়ে আমার চুলের প্রতি ওর খুব টান। ওর ধারণা, চুলগুলো নকল। দেখা হলেই ‘ভাইয়া’ বলে কোলে উঠে চুল ধরে কিছুক্ষণ টানাটানি না করলে ওর মন ভরে না। তবে আজ ও খুব একটা সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হয় না। একদম আর্মি স্টাইলে চুল কাটিয়েছি। মামিকে বললাম, এই সাতসকালে আমাকে ডেকে আনার কারণ কী?
আমরা চিড়িয়াখানায় যাব, তুইও যাবি।
চিড়িয়াখানায় তো চক্রবৃদ্ধি হারে পশু মারা যাচ্ছে। ওখানে গিয়ে কী হবে?
তোর মামাকে জিজ্ঞেস কর। সবই তাঁর ইচ্ছা ।
মামি তৈরি হতে গেলেন। মামার কাছে গিয়ে দেখি, তিনি অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। আমাকে দেখেই বললেন, তুই এসে ভালো করেছিস। পায়জামার ফিতার বিকল্প কী হতে পারে তা নিয়ে ভাবছি। কিন্তু কোনো কূলকিনারা পাচ্ছি না।
পায়জামা না পরে প্যান্ট বা লুঙ্গি পরলেই হয়।
এটা অবশ্য ভালো বলেছিস। মাথায়ই আসেনি। যা-ই হোক। চল, বেরিয়ে পড়ি।
বেরিয়ে পড়ব মানে? কোথায়?
তোর স্থায়ী ঠিকানায়।
মানে কী? আমার স্থায়ী ঠিকানা তো কুষ্টিয়ায়। তুমি কি কুষ্টিয়ায় যাবে?
ব্যাটা উল্লুক! চিড়িয়াখানায় যাব। ওটাই তোর স্থায়ী ঠিকানা। অবশ্য তোকে নিয়ে গেলে ঝামেলা হতে পারে। যদি ওরা তোকে রেখে দিতে চায়? তখন আপা-দুলাভাইয়ের কাছে মুখ দেখাব কী করে?
মামা, চিড়িয়াখানায় তো সব পশুপাখি মারা যাচ্ছে। শুনেছি, ওখানকার পরিবেশও নাকি ভালো না, তাহলে আমরা যাচ্ছি কেন?
আমরা যাচ্ছি লড়াই দেখতে। জিরাফ কীভাবে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে, সেটাই পর্যবেক্ষণ করা হবে। মৃত্যুর আগের পরিস্থিতি নিয়ে সামনের বইমেলায় একটি গবেষণামূলক বইও বের করা হবে। একজন প্রকাশকের সঙ্গে কথা হয়েছে। চান্স ফিফটি-ফিফটি।
জিরাফের মতো সুন্দর একটা প্রাণী মারা যাচ্ছে, আর তুমি তা নিয়ে গবেষণা করতে চাইছ? তুমি এত নিষ্ঠুর কীভাবে হলে?
বকবক করবি না। তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুই ‘জিরাফ বাঁচাও’ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিস। জিরাফ সুন্দর—এ কথা তোকে কে বলল? কেমন হলুদ হলুদ গায়ের রং। কুিসত লাগে।
জিরাফ হলুদ?
ওই একই হলো। যা-ই বলিস না কেন, হলুদ রংটাই খারাপ। পৃথিবীর বেশ কিছু কুিসত বস্তুর রং হলুদ। দু-একটা উদাহরণ দেব নাকি?
না থাক। দরকার নেই।
লেখার ফাঁকে ফাঁকে থাকবে জিরাফ নিয়ে কবিতা। যেমন—
‘ওহে ও দীর্ঘ জিরাপ
মৃত্যুর আগে পেলে না তো হায়
দু-এক ফোঁটা সিরাপ!’ কেমন?
জঘন্য। শব্দটা জিরাপ নয়, জিরাফ।
ছন্দ মেলানোর জন্য কবিরা অনেক কিছুই করে থাকেন। তুই তো বাংলা কবিতার প্রমিত ছন্দ এই বইটা পড়িসনি, পড়লে বুঝতি।
আমি একটা ছন্দই বুঝি— বিটিভির ছায়াছন্দ। আর কিছু বোঝার দরকার নেই।
তা বুঝবি কেন? তুইও তো জিরাফের মতোই লম্বা। জিরাফ পছন্দ না করার এটাও একটা কারণ। লম্বা জিনিসের বুদ্ধি থাকে হাঁটুতে।
তুমি নিজে খাটো বলে এভাবে খোঁটা দিতে পারো না। আমরা হাঁটুর সমান মানুষদের জন্য হাঁটুর বুদ্ধি ব্যবহার করি।
এরই মধ্যে মামি তৈরি হয়ে এলেন। তর্ক আর এগোল না। মামি বললেন, দেখ তো, হলুদ শাড়িতে আমাকে কেমন লাগছে?
আমি তড়িঘড়ি করে বললাম, ভালোই লাগছে। তবে মামা বলছিলেন হলুদ নাকি অতি কুিসত রং। পৃথিবীর কুিসত কিছু বস্তুর রং হলুদ। মামার কাছে মনে হয় তোমাকে ভালো লাগছে না, তাই না মামা?
মামা কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। মামি বললেন, তুই একটু পাশের ঘরে যা। একটা ফয়সালা হয়ে যাক। কত বড় সাহস! আমার প্রিয় রংকে অপমান!
দ্রুত ওই ঘর থেকে কেটে পড়লাম। ওই ঘর এখন রণক্ষেত্র। আমি শতভাগ নিশ্চিত, আজ আর চিড়িয়াখানায় যাওয়া হচ্ছে না। মামির চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। আমি ফ্রিজের দিকে এগোলাম। সকালের নাশতাটা হজম হয়ে গেছে। আরেক ডোজ দেওয়া দরকার।
আদনান মুকিত
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ১২, ২০০৯
Leave a Reply