এখন শহরের অলি-গলিতে সাংবাদিক, ৩০ বছর আগে এ রকম ছিল না। তখন আমরা সাংবাদিককে দেখতে খবরের কাগজের অফিসে যেতাম।
বর্তমানে সাংবাদিক-পপুলেশন বৃদ্ধির কারণ—এ যুগটাই হচ্ছে সংবাদের যুগ।
কিছুকাল আগে এক সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। হঠাত্ আলাপ। আমার বাড়ির সামনে কয়েক দিন তাঁকে ঘুরতে দেখেছিলাম, একখানা নোটবই ও পেন্সিল হাতে। দেখতাম, তিনি মাঝেমধ্যে সেই নোটবইতে কী সব টুকে রাখছেন। পুলিশের লোক ভেবেছিলাম আগে। কৌতূহলে একদিন দু-এক কথায় আলাপ শুরু করলাম, ক্রমে আলাপ জমে উঠল।
তখন কলকাতা শহরে দুর্ভিক্ষে পথে পথে লোক মরছিল। একদিন বলেছিলাম তাঁকে, ‘কেমন দেখছেন সব?’ আমার প্রশ্নটি অবশ্য নিতান্তই অর্থহীন; উদ্দেশ্য, কোনো রকমে একটু আলাপ জমানো।
তিনি বললেন, ‘অদ্ভুত।’
‘কী পরিমাণ লোক মরছে?’
‘স্বাভাবিক।’
কথাটা ভালো বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘স্বাভাবিক মানে কী? প্রতিবেদনটা কীভাবে লিখছেন? যত লোক মরছে, ততটাই কি আপনি আশা করছেন?’
‘মৃত্যুর কথা কিছু লিখছি না।’
‘কেন?’
‘আমাদের দেশে ওটা খবর নয়।’
‘বলেন কি! এত মৃত্যু, এমন অস্বাভাবিক মৃত্যু!’
সাংবাদিক বললেন, ‘আমার চোখে এর কোনোটাই অস্বাভাবিক নয়।’
‘আপনি অবাক করলেন আমাকে।’
‘আমি ঠিকই বলছি। খবর কাকে বলে বোধহয় জানেন না। কুকুর মানুষকে কামড়েছে এটি খবর নয়, মানুষ কুকুরকে কামড়ালে খবর হয়। বিলেতের এক কাগজের অফিসের গল্পটা জানেন? বার্তা সম্পাদকের কক্ষে সবাই বিচলিত, উত্তেজক কোনো খবর সেদিন আসেনি। এদিকে রাত ১২টা বাজে, শেষ কপি দেওয়ার সময় উপস্থিত। এমন সময় এক সহকারী তাঁর নিজের কুকুরটি পাশের ঘর থেকে ধরে এনে টেবিলে তুলে এর পা কামড়াতে লাগলেন, সঙ্গে সঙ্গে খবর তৈরি হয়ে গেল। সম্পাদক তাঁর সহকারীকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগলেন।’
‘তাহলে যারা মরছে, তাদের খবর কী করে হতে পারে?’
‘হতে পারে; যারা মরছে, তারা যদি মারতে পারত। কিন্তু যাক সে কথা, আজ গোটা দুই খবর পেয়েছি। কিছুক্ষণ আগে দুজন কেরানি আমার পাশ দিয়ে বলতে বলতে ছুটে গেল—ভরপেট খেয়ে এভাবে হেঁটে অফিসে যেতে তাদের বড়ই কষ্ট হচ্ছে, ভিড়ের জন্য ট্রাম-বাসে উঠতে পারেনি তারা।’
‘খবর হলো কোথায়, বুঝতে পারছি না।’
‘কেরানি হয়েও পেট ভরে খেতে পেয়েছে, এটি অবশ্যই খবর। আরেকটি খবর—অবশ্য এটি আগেই আমার জানা উচিত ছিল, এই শহরে কোথাও ঘি পাওয়া যায় না।’
আমি বললাম, ‘এ তো পুরোনো খবর, আমরা সবাই জানি, কারণ সব ঘি-তেই ভেজাল থাকে।’
‘ভেজাল ঘিও পাওয়া যায় না।’
‘বলেন কি! হঠাত্ কী হলো? আমি তো জানি ভেজাল ঘিতে বাজার ছেয়ে গেছে, আপনি অসম্ভব কথা বলছেন।’
‘অসম্ভব কথা বলছি বলেই সংবাদ হিসেবে এর দাম খুব বেশি। আর অসম্ভব বলেই এ তথ্য আবিষ্কারে আমার দেরি হয়েছে।’
কথাটা শুনে একটু বিরক্তি বোধ করলাম। বললাম, ‘মিথ্যাকে সত্য বলে চালানোটাও সংবাদ সৃষ্টি নাকি?’
সাংবাদিক এ প্রশ্নে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, বললেন, ‘সত্য আর মিথ্যা বলে কোনো জিনিস নেই। আপনি চোখে দেখেছেন বলে ভাবছেন ঠিক দেখছেন, এই তো? প্রতিটি জিনিস বা ঘটনার অনেক ডাইমেনশন আছে, স্থান ও কালের মধ্যে এর বিস্তার আছে, আপনি হাজার চেষ্টা করলেও একই সময়ে কোনো জিনিসের সব দিক দেখতে পান না, আজ পর্যন্ত কোনো মানুষ তা পায়নি। অতএব, আপনার কাছে যা সত্য, তা-ই বলছেন সত্য, শুধু আমার কাছে যা সত্য, সেটি আপনি মানছেন না।’
আমি বললাম, ‘কিন্তু তাই বলে কোনো জিনিস আছে এবং নেই, একই সঙ্গে সত্য হয় কী করে?’
‘তাও হয়, মশায়, একই সঙ্গে একটি জিনিস চলছে এবং চলছে না, একই সঙ্গে একটি জিনিস ছোট এবং বড়, ভালো এবং মন্দ হতে পারে। বিজ্ঞান এ কথা স্বীকার করেছে। আপেক্ষিকবাদ পড়ুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন, আপনি যাকে একমাত্র সত্য বলে চেপে ধরে আছেন; দেখবেন, তা আপনার মুঠোর মধ্যেই মিথ্যা হয়ে আছে।’
‘তা যদি হয়, তাহলে আপনার কথাগুলোও তো সত্য না হতে পারে।’
‘অবশ্যই না হতে পারে। আমি তো বলছি না যে আমার কথা ধ্রুব সত্য।’
‘তাহলে বাজারে ঘি-ও নেই, ভেজাল ঘি-ও নেই, এই দুটি কথাকে আপনি খবর হিসেবে চালাবেন কী করে?’
‘এটা সম্পূর্ণ পৃথক প্রশ্ন। আপনি যেদিক থেকে দেখে বলছেন বাজারে ভেজাল ঘি আছে, আমি সেদিক থেকে দেখছি না। আমি অন্য দিক থেকে দেখে বলছি, বাজারে ঘি-ও নেই, ভেজাল ঘি-ও নেই।’
‘তাহলে কী আছে?’
“আছে ‘বিশুদ্ধ ঘি’ অথবা ‘খাঁটি ঘি’। ঘি নেই। ‘বিশুদ্ধ ঘি’ অথবা ‘খাঁটি ঘি’ ঘি থেকে পৃথক। তেমনি ধরুন, বাজারে দুধ নেই, আছে শুধু বিশুদ্ধ দুধ। হোটেল নেই, আছে পবিত্র হোটেল।”
কথাটা শুনে স্তম্ভিত হচ্ছিলাম, এমন সময় সামান্য দূরেই গুরুতর দুর্ঘটনা ঘটায় আমাদের আলোচনা হঠাত্ বন্ধ হয়ে গেল। একখানা বাস দারুণ শব্দ করে থেমে গেল, সবাই চিত্কার করে উঠল একসঙ্গে। মুহূর্তে সেই বাস ঘিরে দুর্ভেদ্য ভিড় জমে উঠল। শোনা গেল, বাস একটি স্কুলের মেয়েকে চাপা দিয়েছে।
ভিড় ঠেলে দুর্ঘটনা দেখার শক্তি বা প্রবৃত্তি আমার ছিল না, বলা বাহুল্য আমার সঙ্গে আলাপরত সাংবাদিক বহু আগেই অদৃশ্য হয়েছিলেন সেই ভিড়ের মধ্যে।
অতিরিক্ত আরও একটি দুর্ঘটনা ওই একই সঙ্গে ঘটেছে, শোনা গেল বাইরে থেকেই। বাসের ড্রাইভারকে উপস্থিত জনতা এরই মধ্যে মেরে আধমরা করে ফেলেছে।
পরদিন খবরের কাগজে দুর্ঘটনার বিবরণ পড়তে অতি-উত্সাহে তিনখানা কাগজ কিনলাম। সত্য দৃষ্টি সম্পর্কে নবলব্ধ জ্ঞানই আমাকে এ কাজে প্রেরণা জুগিয়েছিল। যাচাই করে দেখছিলাম, বিভিন্ন প্রতিবেদক একই ঘটনা কীভাবে দেখেছেন।
একখানা কাগজ লিখেছে, মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল পথে, বাস তার ঘাড়ে এসে পড়ে। আর একখানা কাগজ লিখেছে, বাসচালকের কোনো দোষ নেই, মেয়েটি এমন অতর্কিতে চলন্ত বাসের সামনে এসে পড়ে যে, সে অবস্থায় বাস থামানোর প্রশ্নই ওঠে না। আরেক কাগজ লিখেছে, মেয়েটি কলার খোসায় পা পিছলে চলন্ত বাসের নিচে পড়ে গেছে।
কয়েক দিন পর দেখা হলো ওই সাংবাদিকের সঙ্গে। বললাম, ‘আপনি সেদিন ঠিকই বলেছিলেন, একই ঘটনা নানাজনে নানাভাবে দেখে।’
‘কী করে বুঝলেন?’
‘দুর্ঘটনার পরদিন আমি তিনখানা কাগজ কিনেছিলাম। দেখলাম, কোনোটার সঙ্গেই কোনোটা মেলে না, তিন কাগজে তিন রকম প্রতিবেদন।’
তিনখানা কাগজের নাম বললাম। সাংবাদিক মৃদু হেসে বললেন, ‘ওই তিনখানা কাগজেরই প্রতিবেদক আমি নিজে।’
(ঈষত্ সংক্ষেপিত)
পরিমল গোস্বামী: সাংবাদিক ও গল্পকার। জন্ম ১৮৯৭, মৃত্যু ১৯৭৬।
সূত্র: প্রথম আলো, অক্টোবর ০৫, ২০০৯
Leave a Reply