এখন অক্টোবর মাস। নোবেল পুরস্কারের মৌসুম। বিশ্বের অনেক খ্যাতনামাদের মনটা দুরুদুরু করছে। অনেক দিনের আরাধ্য নোবেল পুরস্কারটি হাতে আসবে তো। আমরা যারা আমজনতা, তাদের এতে আর কী আসে যায়? রস-কসহীন বিজ্ঞানের ওই জটিল গবেষণাগুলোকে কেন স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তা আমাদের মাথায় ঢুকতেই চায় না। সাধারণ মানুষের এ অবস্থাটা হয়তো বুঝতে পেরেছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিদ্রূপাত্মক বিজ্ঞান সাময়িকী অ্যানালস অব ইমপ্রোবেবল রিসার্চ। তারা ১৯৯১ সাল থেকে নোবেল পুরস্কারের আগে আগে দিচ্ছে মজার ‘ইগ নোবেল’ পুরস্কার। এ পুরস্কারের মাধ্যমে সেসব বৈজ্ঞানিক গবেষণাকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যেগুলো ‘আগে মানুষকে হাসায়, পরে ভাবায়’।
ইগ নোবেল প্রাইজ যে নোবেল প্রাইজের প্যারোডি এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু জেনে রাখুন, সত্যিকারের নোবেল বিজয়ীরাও কিন্তু এ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আসেন, বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন। আর পুরস্কারগুলো মজার গবেষণার জন্য দেওয়া হলেও, এর প্রতিটিরই কিন্তু বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব আছে। অনেক গবেষকই সাদরে এ পুরস্কার গ্রহণ করে। অবশ্য অনেকেই এর রসাত্মক দিকটা বুঝতে না পেরে রাগান্বিত হন।
গত বৃহস্পতিবার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যান্ডার্স থিয়েটারে হয়ে গেল ১৯তম ইগ নোবেল পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান। এতে উপস্থিত থেকে বিজয়ীর হাতে পুরস্কার তুলে দেন ২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী ওরহান পামুক, রিচ রবার্টস (চিকিত্সা, ২০০১), পল ক্রুগম্যান (অর্থনীতি, ২০০৮) ছাড়া আরও ৬ জন নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্ব।
গর্ভবতী নারীরা কেন ভারসাম্য হারিয়ে উল্টে পড়েন না, গরুরা কি মানুষের মমতা টের পায়, আঙুল ফোটালে কি আর্থ্রাইটিস হয়—এ ধরনের আরও অনেক প্রশ্নের জবাব মিলেছে এবারের আয়োজনে।
ওয়েবসাইট অবলম্বনে বিস্তারিত জানাচ্ছেন শরীফ উল্লাহ
চিকিত্সা
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার থাউজেন্ড ওকসের বাসিন্দা ডোনাল্ড এল আঙ্গার ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কেবল বাঁ হাতের আঙুল ফুটিয়েছেন, কখনোই ডান হাতের আঙুলগুলো ধরেননি। তিনি এটা করেছেন শুধু এটা দেখার জন্য যে আঙুল ফোটালে আরথ্রাইটিস হয় কি না।
ছেলেবেলায় ডোনাল্ডের মা তাঁকে আঙুল ফোটাতে নিষেধ করেছিল। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন তাঁর মা সর্বজ্ঞ। কিন্তু একটু বড় হয়ে বিজ্ঞানের সংস্পর্শে এসে মায়ের এই আদেশের প্রতি একটু সন্দিহান হয়ে উঠলেন তিনি। এরই ফসল এই দীর্ঘ ৬০ বছরের সাধনা। তিনি প্রতিদিন দুবার বাঁ হাতের আঙুল ফোটাতেন। কিন্তু ৬০ বছর পর তাঁর কোনো হাতেই আরথ্রাইটিস হয়নি। ‘মা, তুমি ভুল বলেছিলে’—স্বর্গবাসী মায়ের উদ্দেশে এটাই ডোনাল্ডের বক্তব্য।
অর্থনীতি
আঙুল ফুলে কলাগাছ—অর্থনীতিতে এ প্রবাদটি প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থনীতির ইগ নোবেল জিতল আইসল্যান্ডের চারটি ব্যাংক। কপথিং ব্যাংক, ল্যান্ডসবাংকি ব্যাংক, গ্রাইনির ব্যাংক ও সেন্ট্রাল ব্যাংক অব আইসল্যান্ডের পরিচালক, নির্বাহী ও অডিটররা সন্দেহাতীতভাবে অর্থনৈতিক মন্দার সাময়িক সুফল দেখাতে পেরেছেন। এ সময় ছোট ব্যাংকগুলোও ফুলে-ফেঁপে উঠতে পারে। এবং ধ্বস নামাটাও কেবল সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আর এ তত্ত্ব জাতীয় অর্থনীতির জন্যও প্রযোজ্য।
শান্তি
ভরা বিয়ারের বোতল, না খালি বিয়ারের বোতল—মানুষের মাথা লক্ষ্য করে ছুড়ে মারা হলে কোনটা কম ক্ষতিকর তা বের করেছেন সুইজারল্যান্ডের বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের স্টিফান বলিগার, স্টিফেন রস, লার্স ওয়েসটারহেলওয়েগ, মাইকেল থালি ও বিট নিউবুয়েহল। এ জন্য শান্তিতে ইগ নোবেল জিতে নিয়েছেন তাঁরা।
তাঁদের গবেষণায় দেখা গেছে, খালি বোতলের চেয়ে ভরা বিয়ারের বোতলগুলো কম ক্ষতিকর। ভরা বোতলগুলো ৩০ জুল পর্যন্ত আঘাত সইতে পারে। খালি বোতল সইতে পারে ৪০ জুল। অবশ্য দুই ধরনের বোতলই মানুষের খুলির দুর্বল অংশ ভাঙতে সক্ষম।
ভেটেরিনারি মেডিসিন
গরুর বেশি দুগ্ধ উত্পাদনের রহস্য ভেদ করার জন্য ভেটেরিনারি মেডিসিনের পুরস্কারটি পেয়েছেন ব্রিটেনের নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বিভাগের গবেষক ক্যাথেরিন ডগলাস ও পিটার রাওলিনসন। ৫১৬টি খামারে জরিপ চালিয়ে তাঁরা দেখেছেন, গরুর সুন্দর একটা নাম রেখে নিয়মিত সে নাম ধরে ডাকলে তারা নামহীন গরুর চেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি দুধ দেয়। গবেষকদের মতে, গরুর নাম ধরে ডাকলে তারা খুশি হয় ও নিশ্চিন্ত থাকে। এটাই তাদের একটু বেশি দুধ উত্পাদন করতে সহায়তা করে।
সদ্য মা হওয়ায় ক্যাথেরিন অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। তবে তিনি গরুর মতো পোশাক জড়ানো তাঁর নতুন সন্তান ও একটি গরুসহ তাঁর ছবি পাঠিয়েছেন।
গণিত
জিম্বাবুয়ের নাগরিকেরা এখন আর বড় কোনো সংখ্যা দেখে ঘাবড়ায় না। এর পুরো কৃতিত্ব কিন্তু জিম্বাবুয়ের রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর জাইডেন গোনোর। ২৩ কোটি শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি সামাল দিতে এক সেন্ট (.০১) থেকে এক শ ট্রিলিয়ন ডলার (১০০,০০০,০০০,০০০,০০০) পর্যন্ত ব্যাংকনোট প্রচলন করেছেন তিনি। জিম্বাবুয়ের শিশুরাও এখন তাই বিশাল বিশাল সংখ্যা নিয়ে খেলা করতে পারছে।
রসায়ন
মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের হাভিয়ার মোরালেস, মিগুয়েল অ্যাপাটিগা ও ভিক্সর এম ক্যাসটানোর ওপর সে দেশের মদ্যপায়ীরা খেপতে পারে। কারণ তাঁরা মাতাল করা ছাড়াও মদের অন্য রকম ব্যবহার বের করেছেন। মেক্সিকোর জনপ্রিয় পানীয় টাকিলা থেকে খুবই শক্তিশালী সেমিকন্ডাকটর ডায়মন্ড ফ্লিম (ঈশ্বর জানে, এটা কি কাজে লাগে) তৈরির জন্য তাঁরা পেয়েছেন রসায়নের ইগ নোবেল পুরস্কার।
পদার্থবিদ্যা
গর্ভবতী নারীরা হাঁটতে গিয়ে কেন উল্টে পড়ে না, এর কারণ বের করেছেন সিনসিনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাথেরিন কে উইটকাম, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যানিয়েল ই লিবারম্যান ও টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের লিজা জে শাপিরো। ছোট শিশুরা ছাড়া গর্ভবতী কোনো নারীকে এ প্রশ্নটা করার সাহস করে না কেউই। তাঁরা সাহস করে এ গবেষণা করার জন্য পদার্থবিদ্যায় ইগ নোবেল পেয়েছেন।
তাঁরা বের করেছেন নারীদের পিঠের নিচের অংশ ছেলেদের চেয়ে বেশি বাঁকা। তাই মেরুদণ্ডের ওপরের অংশ একটু পেছনে হেলে থাকে। গর্ভাবস্থায় এটা তাদের চলাফেরায় ভারসাম্য আনে।
জনস্বাস্থ্য
বক্ষবন্ধনীর প্রাণ রক্ষাকারী ব্যবহার বের করার জন্য জনস্বাস্থ্যে পুরস্কার জিতেছেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলের এলেনা এন বডনার, রাফায়েল সি লি ও সান্ড্রা মারিজান। তাঁরা উদ্ভাবন করেছেন গ্যাস মাস্কে রূপান্তর যোগ্য বক্ষবন্ধনী। জরুরি অবস্থায় জামার নিচ থেকে একটানে খুলে এ বক্ষবন্ধনী দিয়ে দুটো গ্যাস মাস্ক বানানো যাবে। একটা নিজের জন্য রেখে আরেকটা দেওয়া যাবে সঙ্গীকে। যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট পেয়েছে এই বক্ষবন্ধনী। এলেনা বডনার মঞ্চে উপস্থিত হয়ে এ বক্ষবন্ধনীর কার্যকারিতা প্রদর্শন করেন।
চেরনোবিল দুর্ঘটনার সময় তিনি ইউক্রেনে ছিলেন। জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতিতে প্রস্তুত থাকার বিষয়টি তো তাঁর মাথাতেই বেশি খেলবে। আগুনের ধোঁয়ার সময় তো বটেই, পারমাণবিক দুর্ঘটনা ও জীবাণু অস্ত্রের হামলায় কাজে আসবে ব্রা কাম মাস্ক।
সাহিত্য
আয়ারল্যান্ডের ট্রাফিক পুলিশ বিভাগ সে দেশে সবচেয়ে ঘন ঘন ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারী নাগরিক প্রাউয়ো জাজডির বিরুদ্ধে ৫০টিরও বেশি মামলা করেছে। আর এসব নথি লেখা ও উপস্থাপনা করতে গিয়ে পুলিশ বিভাগ জিতে নিয়েছে সাহিত্যে ইগ নোবেল পুরস্কার। পোলিশ ভাষায় ‘প্রাউয়ো জাজডি’র নামের অর্থ আবার ‘ট্রাফিক লাইসেন্স’। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পোলিশ নাগরিক ক্যারোলিনা লিউয়েসটাম। তিনি আয়ারল্যান্ডের সব পোলিশ চালকের হয়ে আইরিশ পুলিশ সার্ভিসের শুভ কামনা করেছেন।
জীববিদ্যা
জাপানের সাগামিহারার কিতাসাতো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব মেডিকেল সায়েন্সের ফুমিয়াকি তাগুচি, সং গুফু ও ঝ্যাং গুয়াংলি ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন জায়ান্ট পান্ডার মল। তাঁরা দেখিয়েছেন, জায়ান্ট পান্ডার মলে থাকা ব্যাকটেরিয়াগুলো অন্যান্য ব্যাকটেরিয়ার তুলনায় গৃহস্থালী জৈব আবর্জনা পঁচানোর জন্য বেশি কার্যকর।
সূত্র: প্রথম আলো, অক্টোবর ০৫, ২০০৯
Leave a Reply