ঈদের দিন মফস্বলের এক রেস্তোরাঁয় বসে চা খাচ্ছিল দুই বন্ধু। চা এমনিতে আট টাকা কাপ। রেস্তোরাঁর টিভিতে সন্ধ্যার সংবাদে চিনির দাম বাড়ার খবরটা প্রচারিত হলো। দুই বন্ধু চায়ের বিল দিতে গিয়ে অবাক। চায়ের দাম এরই মধ্যে বেড়ে গেছে প্রতি কাপে দুই টাকা!
আরেকটা ঘটনা। ঈদের পরপরই দেশে বিয়ের ধুম লেগেছে। বিয়ের ধুমে ঘুম নেই বাবুর্চিদের, কসাইদের। দীর্ঘদিন প্রেম করে এলাকার হার্টথ্রব মেয়েটা শেষ পর্যন্ত বিয়ে করে বসল এক ব্যবসায়ীকে। লোকটার আগের বউ গত হয়েছেন মাস তিনেক আগে। এ মেয়ের এমন একজন মধ্যবয়সী লোককে বিয়ে করার পেছনে দ্বিতীয় কোনো কারণ নেই। একটাই কারণ, সেটা হলো, লোকটার গুদামে তখন কয়েক হাজার মণ চিনি ছিল। চিনির লোভে পিঁপড়া আসে। দিন পাল্টেছে। ইদানীং চিনি ব্যবসায়ীরাই সুন্দরী বউ পায়। এ থেকে দেশের তরুণসমাজের কিছু শেখার আছে। তা হলো, শুধু শুধু প্রেম করে, ভ্যালেন্টাইনস ডে পালন করে, ফুল কিনে প্রেমিকার পেছনে ছুটে ছুটে সময় নষ্ট না করে চিনির ব্যবসায় নামুন; প্রেমিকাই আপনাকে খুঁজে বের করবে।
অনেক দিন আগের কথা। কর্ণফুলী নদীর পানি একবার নাকি মিষ্টি হয়ে গিয়েছিল। ঘটনা আর কিছুই না। চিনিবাহী একটা জাহাজ ডুবে গিয়েছিল কর্ণফুলীতে। তখন অনেকেই নাকি কর্ণফুলীর পানি বাসায় নিয়ে চা বানিয়ে খেয়েছেন।
যে দেশের পানিতে চিনি আর নেতাদের কণ্ঠে বারো মাস মিষ্টি ঝরে, সে দেশের জনগণ চিনি কেনে দ্বিগুণ দামে, মেনে নেওয়া সত্যি একটু কঠিন। ‘চিনি জাফর’ নামে জাতীয় পার্টির একজন নেতাও আছেন। তিনি চিনি নিয়ে একসময় ছিনিমিনি করতে গিয়ে কেলেঙ্কারি বাধিয়েছিলেন। এর পর থেকেই তাঁর নাম হয়ে যায় চিনি জাফর। একজন চিনি জাফরই সব নয়, দেশে এখন ভূরি ভূরি চিনিব্যক্তিত্ব। তাঁদের সবার নাম কি আর আমরা জানি? সেদিন পত্রিকায় ছাপা হলো, একটি গুদাম থেকে হাজার হাজার বস্তা চিনি আটক করেছে র্যাব। এর পরদিন খবর পেলাম, পুলিশি পাহারায় চিনি বিক্রি হয়েছে অনেক বেশি দামে। পুলিশ বলেছে, তাদের কাজ বিক্রি নিশ্চিত করা, চিনির দাম কমানো নয়। আসলে দাম বাড়ানো নিশ্চিত করতে পারলেই আমাদের প্রশাসনের দায়িত্ব শেষ, কমানোর দায়িত্বটা যে কার, সেটা একটা রহস্য।
সব সময় দেখে এসেছি, প্যাকেটজাত পণ্যের কদর বেশি থাকায় অসাধু (!) ব্যবসায়ীরা রাতের বেলা নিজেরাই বস্তার পণ্য মোমবাতি জ্বালিয়ে দোকানের ভেতরই প্যাকেট করেন। কিন্তু এবার চিনির বেলায় ঘটেছে উল্টো ঘটনা। এবার রাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে নয়, দিনের বেলায় ৩০ টাকার বিভিন্ন প্যাকেটজাত চিনির প্যাকেট কেটে বস্তার চিনির সঙ্গে মিশিয়ে বিক্রি করেছেন আমাদের সুযোগসন্ধানী মহান ব্যবসায়ীরা। তবে যে যা-ই বলুক, আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের ইউনিটি দেখে ঈর্ষান্বিত হওয়া ছাড়া উপায় নেই। আর এসব দেখে এবং সরকারপক্ষের কথার ফুলঝুরি শুনে মনে হয়, ক্যাপিটালিজমের রঙিন প্যাকেটে মোড়া সোশ্যালিজমের ফ্লেভার দেওয়া এক অনন্য গণতান্ত্রিক দেশে বাস করছি আমরা। দিব্যি খাই, ঘুমাই যেন—চিনি!
কেন, কী হয়েছে?
প্রতিদিনই তো কিনি।
দাম বেড়েছে ওটার?
কই, একটুও তো টের পাইনি!
অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেলে অনেক কিছুই টের পাওয়া যায় না। এ দেশের জনগণ টের পাওয়াপাওয়ির অনেক ঊর্ধ্বে চলে গেছে। তবে চিনির দাম বাড়ায় এর একটু ভিন্ন রকম প্রভাব পড়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। দুটি প্রধান দলেরই কিছু নেতার মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা বের হয়নি। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা জনাব জলিল সাহেব দল নিয়ে, প্রধানমন্ত্রী নিয়ে ইদানীং যেসব কথা বলেছেন, সেগুলো খুবই তেতো। যেন চিনিমাখা দুধভাতে তেঁতুলের টক মিশিয়ে দিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে বিএনপি সব সময়ের মতো আবারও বেকায়দায় পড়েছে কুকুরের লেজবিষয়ক তার বিশেষজ্ঞ মুখরা নেতা সাকা চৌধুরীকে নিয়ে। তিনি বলছেন, তিনি নাকি বিএনপির অ্যান্টিবায়োটিক। সাকা সাহেবকে নিয়ে অনেক হয়েছে, নতুন করে আর কিছু বলার নেই। শুধু বলতে ইচ্ছে হয়, এই যদি হয় অ্যান্টিবায়োটিক, তাহলে রোগের ধরনটা না-জানি কী! তাঁদের জন্য হলেও ব্যবসায়ীদের চিনির দাম কমানো উচিত। চিনি খেয়ে যদি তাঁদের মুখ কিছুটা মিষ্টি হয়, জনগণ না হোক, দলের অন্য নেতারা যাতে একটু মিষ্টি কথা শুনতে শুনতে আরামে ঘুমাতে পারেন।
ঈদের পরপরই একজন বলল, চিনির কেজি নাকি ৭০ টাকা। চিনি বিষয়ে এমন তেতো কথা শুনে ব্লাডে সুগার বেড়ে প্রেশার বেড়ে গেলেও নিচু স্বরে কারণ জানতে চাইলাম। লোকটা বলল, সরকারের কেউ একজন নাকি চিনির দাম কমানো নিয়ে কী একটা বলেছেন, এর পরপরই দাম বেড়ে গেছে। এ যেন মিষ্টি কথায় চিনি উজাড়। আমাদের সরকারগুলো যদি সব সময় যা বলা উচিত এর উল্টোটা বলত, তাহলে জনগণ হাঁপ ছেড়ে বাঁচত। কেন জানি তাদের কথাগুলো সব সময় আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাসের মতো বিপরীত ফল দেয়!
তাওহিদ মিলটন
সূত্র: প্রথম আলো, অক্টোবর ০৫, ২০০৯
Leave a Reply