রাস্তায় আমাদের পাড়ার প্রেসের ম্যানেজার দ্বিজেনবাবু কীসব আপন মনে বকছেন। কাছাকাছি গিয়ে শুনতে পেলাম, দ্বিজেনবাবু বলছেন, “দুশো ‘র্জ’, ছশো ‘ং’, একশো ‘ণ্ড’, দুশো ‘র্ক’।” আমি বললাম, ‘দ্বিজেনবাবু কী বলছেন, কী হলো?’
দ্বিজেনবাবু বললেন, “এই তো মাটি করে দিলে সব। আমি সব এক এক করে ভাবছিলাম, আর তুমি এসে সব গুলিয়ে দিলে—বুর্জোয়ার ‘র্জ’, পিকিংয়ের ‘ং’, লণ্ডনের ‘ণ্ড’, আর নিউইয়র্কের ‘র্ক’, কিন্তু এতে তো হবে না। আরও বাড়াতে হবে।”
আমি বললাম, ‘ঠিক বুঝতে পারছি না।’
দ্বিজেনবাবু বললেন, ‘ওয়াশিংটনের ং এসে যাবে। আরও ং-এর দরকার হবে।’ আমি বললাম, ‘ওয়াশিংটনের ং এসে যাবে কেন?’
দ্বিজেনবাবু বললেন, ‘ং ছাড়া ওয়াশিংটন আপনি কী দিয়ে লিখবেন? তা ছাড়া এবং-এর ং আছে। ছশোয় কুলোবে কি না সন্দেহ।’ আমি বললাম, ‘ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলবেন?’ দ্বিজেনবাবু আমার কথা বোধ হয় শুনতেই পেলেন না। তিনি বলতে লাগলেন, ‘এর পর আছে আবার হংকং, ইয়াং-সিকিয়াং। হাজার খানেক ং দরকার।’
দ্বিজেনবাবু বললেন, ‘আর বোলো না ভাই। এই আমার ব্যবসা। পুজোর সময়ে পত্রিকা ছাপিয়ে যা হয়, বছর প্রায় চলে যায়। কিন্তু ছাপাতে গেলে টাইপ কিনতে হয়, নিজে তো টাইপ বানাই না। কিছু কিছু টাইপ অবশ্য মজুদ থাকেই, কিন্তু হঠাত্ এক এক টাইপের বেশ দরকার হয়ে পড়ে! তাই হিসাব করছিলাম, এবারে কী টাইপ বিশেষ প্রয়োজন হতে পারে!’
আমি বললাম, ‘ও, বিশেষ টাইপের কথা ভাবছিলেন বুঝি?’
দ্বিজেনবাবু বললেন, “হ্যাঁ ভাই, ভাবছিলাম। কত রকম যে এর হিসাব আছে, তার কি সীমা আছে? পুজোসংখ্যা যখন, তখন সুন্দর, শক্তি, ভক্তি এসব কথার বান ডাকবে। অতএব এক মাস আগে থাকতেই আমি ‘ন্দ’, ‘ক্ত’, এসব জমিয়ে রেখেছি। কিন্তু সবচেয়ে অসুবিধে হয় ওই কমিউনিস্টদের বেলায়। ওরা আমাকে দিয়ে মাঝেমধ্যে কাগজ ছাপিয়ে নেয়, কী করি, ব্যবসার খাতিরে সবার সঙ্গেই ভাবটাব রাখতে হয়। কিন্তু ওদের ঠিক থাকে না সব সময়। কত ফর্মা হবে, কে লিখবে, এক বই ঘণ্টায় ঘণ্টায় পালটে যায়, কিন্তু ওরা টাকা দেয় ভালো—ওদের জন্য ‘র্জ’ কিছু রাখি।” ‘কেন?’
“বুঝলে না? ওরা প্রবন্ধ লিখলে বুর্জোয়া কথাটা ব্যবহার করবেই। প্রতি তিন লাইনে একটা বুর্জোয়া। ষোল পাতার ফর্মা, ওখানেই চলে গেল আটচল্লিশটা ‘র্জ’, অন্তত তিন-চার ফর্মার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়, তাই শ দুই ‘র্জ’ আনতে হবে, তাই ভাবছিলাম। এ গেল এক্সট্রা, আমার ‘র্জ’ একেবারে নেই তা নয়। কবিরাও ‘র্জ’ তো কম ব্যবহার করে না!”
‘কবিরাও? ওরাও কি কমিউনিস্ট?’
দ্বিজেনবাবু বললেন, ‘সব কবিই যে কমিউনিস্ট তা নয়, তবে মোটামুটি আমার ধারণা, অধিকাংশ কমিউনিস্ট। নইলে ওরা প্রায় জর্জর হয় কেন? কবিতা পড়লেই দেখবেন কবিরা বেদনায় ধুঁকছে। অধিকাংশই জর্জর। তবে তারাপদ যে আমাকে ডোবাবে ভাবিনি।’
‘আপনাকে তারাপদ ডুবিয়েছে?’
“মশাই, ওর জন্য সেবার একটি ফর্মার দেড়শো র্জ লেগেছিল!” ‘দেড়শো?’
দ্বিজেনবাবু আক্ষেপের সঙ্গে বললেন, ‘দেড়শো। প্রথম দু-পাতা ধরে তো বিদেশি জিনিস বর্জন সম্বন্ধে বিরাট বক্তৃতা। তারপর বৈপ্লবিক কথাবার্তা—সার্জারি কথাটা ব্যবহার করল পঁচিশবার। তাও ভালো অস্ত্রোপচার করেনি—তাহলে যেতাম।’ ‘অস্ত্রোপচার করলে আপনি যেতেন কেন?’ ‘অস্ত্রোপচার করলে কেউ বাঁচে? যা-ই হোক, সে কথা ঠিক নয়। আমার ‘স্ত্রী’ মাত্র দশটা ছিল শেষমেশ।’ ‘শেষমেশ কেন? এর আগে স্ত্রী খুব ব্যবহার করে ফেলেছিলেন বুঝি?’
দ্বিজেনবাবু বললেন, ‘আমি ব্যবহার করব কেন? এইটুকু পুচকে মেয়ে—হারুদার মেয়ে চপলা, সে পাড়ার ম্যাগাজিনে স্ত্রী স্বাধীনতা নিয়ে এক পেল্লাই প্রবন্ধ লিখেছিল, ব্যস, আমার ‘স্ত্রী’ খতম। এবার স্ত্রী মজুদ রেখেছি ফিদেল কাস্ত্রোর জন্য।’
দ্বিজেনবাবু বললেন, ‘প্রেসের কাজে বড় ঝঞ্ঝাট, মশাই। আমরা কয়েকটা ‘র্দু’ রাখি। সেবার আমাদের প্রেস থেকে একটি নতুন লোক ‘র্দু’ চুরি করে সরে পড়ল। দু-সের ‘র্দু’ ছিল মশাই। অত ভালো ‘র্দু’ কি আর পাব? সেই ইংরেজ আমলের র্দু। ভালো ‘র্দু’ মশাই! প্রেস চালানোর মতো বদ কাজ আর নেই।’
বললাম, ‘তবে যে শুনি সম্পাদকের মতো বদ কাজ আর হয় না?’ দ্বিজেনবাবু বললেন, ‘ভুল। ভুল শুনেছ।’ বলতে না বলতেই চলতি একটা ট্রামে উঠে পড়লেন।
এমন সময় দেখি, প্রিয়ব্রতবাবু দৌড়াতে দৌড়াতে একটা থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগলেন। বললাম ‘ও প্রিয়ব্রতবাবু, হলো কী?’ প্রিয়ব্রতবাবু একজন লেখক। তাঁর দু-খানা বই সিনেমাওয়ালা কিনেছে, আর দু-খানা বই পুলিশ বাজেয়াপ্ত করেছে; বিরাট নামকরা লোক। আমি গিয়ে বললাম আবার, ‘ও প্রিয়ব্রতবাবু, হলো কী?’
প্রিয়ব্রতবাবু বললেন, ‘দড়ি বেয়ে নেমে এলাম।’ ‘আপনি তো তিনতলায় থাকেন? সেখান থেকে দড়ি বেয়ে নেমে এলেন?’
‘নেমে এলাম।’ তিনি বললেল, ‘এক সম্পাদক দেখা করতে এসেছিলেন।’ ‘কেন?’
‘মশাই, আর বলবেন না। উপন্যাস দেব বলেছিলাম—দিয়েছি, কিন্তু ভুল করে, নেহাত ভুল করে একটা ছোটগল্প ওর মধ্যে চলে গিয়েছে—সে গল্পটা অন্য একটি কাগজের জন্য লিখেছিলাম। এখন মুশকিল হয়েছে কি, ওরা তো আমার উপন্যাসের মধ্যে ছোটগল্পটা ছেপে দিয়েছে। তাই আর কি, সম্পাদকের চাকরি যায় যায়। এখন তিনি একটা পকেট-হাতুড়ি নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন, তাই দেখেই দড়ি বেয়ে নেমে এসেছি।’ ‘দড়ি বেয়ে! দড়ি কোথায় পেলেন?’ ‘বহু দিন আগে থেকেই দড়ির খেলা শুরু করেছি। গোলমাল তো আজ নতুন হলো না। একবার একটি ছোটগল্প লিখেছিলাম, তার নাম দিয়েছিলাম ‘ভুবন তো আজ হল কাঙাল’। ব্যস, আমার প্রাণ অতিষ্ঠ।’ ‘কেন?’ ‘মাসিকপত্রের মালিকের নাম ভুবন জানতাম না। শেষ পর্যন্ত নাম বদলে দিতে বাধ্য হলাম!’
‘কী নাম দিলেন?’
‘সুবীর তো আজ হল কাঙাল!’
‘কেল্লা ফতে?’ ‘না। শেষ পর্যন্ত আর্টিস্ট হেডপিস করল, ‘সুবীর তো আজ হল বাঙাল’! কেউ লক্ষ্য করেনি। যখন ছাপা হলো তখন মালিক বললেন, সম্পাদককে, ‘এ কিডা লিখছে?’ বুঝুন ঠ্যালা, সম্পাদক দুজন গুন্ডা পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু ওই দড়ির খেলায় বেঁচে গিয়েছিলাম।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘এবার কতগুলো লিখছেন?’ প্রিয়ব্রতবাবু বললেন, ‘সাতখানা উপন্যাস, পনেরোটা গল্প আর ছটি কবিতা।’ ‘কবিতা?’ ‘কবিতা লিখতে পারি জানতাম না। একবার একজন সম্পাদক আমাকে লেখার জন্য চিঠি লিখলেন, পঁচিশ টাকা দেবেন একটি পুজোসংখ্যার গল্পের জন্য। আমি লিখলাম: ভাই, কী করে লিখি। টাকাও তো বেশি নয়। জামাকাপড় ইত্যাদি বাবদ যা খরচ হবে, তার জন্য পঁচিশ টাকা অতি সামান্য নয় কি? পঞ্চাশ হলে দেখতে পারি। ইতি।
তারপর আর কোনো সাড়া নেই। দেখি ওরা কবিতা বিভাগে ওই চিঠিটাই ছেপেছে—
ভাই,/গল্প কী করে/লিখি?/টাকাও তো বেশি নয়।/জামাকাপড় ইত্যাদি বাবদ/যা খরচ হবে তার/জন্য পঁচিশ টাকা অতি সামান্য।/ নয় কি? পঞ্চাশ হলে/দেখতে পারি।
তারপর থেকে কবিতাও লিখতে শুরু করেছি।’ বললাম, ‘কিন্তু অতগুলো উপন্যাস লেখা কি কম পরিশ্রমের?’ প্রিয়ব্রতবাবু বললেন, ‘বড় উপন্যাস তো লিখি না। ওই এক-একখানা দশ-বারো পাতার উপন্যাস লিখি।’ আমি বললাম, ‘অত ছোটকে উপন্যাস বলেন কেন?’
প্রিয়ব্রতবাবু বললেন, ‘এককালে যেগুলোকে রসমুণ্ডি বলা হতো, তার নাম আজকাল রসগোল্লা হয়েছে, দেখেছেন?’ ‘হ্যাঁ’ ‘এও তাই। শুনছি, দু-একজন বড় ঔপন্যাসিক তিন পাতার উপন্যাসও লিখতে লেগে গিয়েছেন।’ তারপর প্রিয়ব্রতবাবু দেখলেন, দূরে কে যেন চলে যাচ্ছে। তারপর বললেন, ‘আজ আসি?’ প্রিয়ব্রতবাবু চলে গেলেন।
খানিক পর দেখি, দ্বিজেনবাবু ফিরছেন রিকশায় করে। আমাকে দেখে রিকশা থামালেন। বললেন, ‘সর্বনাশ হয়েছে, সব পেলাম কিন্তু ‘ং’ আর পেলাম না। খুব কাটতি হয়েছে ওই ং-এর। ভারত, তিব্বত আর চীন সীমান্ত নিয়ে সব পত্রিকাতেই দুটো করে গড়ে প্রবন্ধ যাচ্ছে।’
বললাম, ‘এবারে তাহলে কী করবেন?’
দ্বিজেনবাবু বললেন, “এবংগুলো কেটে ‘ও’ করব। আর কিছু ‘ঙ’ দিয়েও কাজ চালাব। চালাতেই হবে। উপায় কী?”
[সংক্ষেপিত]
হিমানীশ গোস্বামী: লেখক।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০০৯
Leave a Reply