‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়’ কথাটি যুগ যুগ ধরে চলে এলেও আজকাল বোধ হয় ‘বংশের পরিচয়ে ব্যবহার’ বললেই সবচেয়ে খাঁটি কথাটি বলা হয়। এ ভেজালের জমানায় একটি খাঁটি কথা বলা কিন্তু কম সাহসের কথা নয়।
যা-ই হোক, খাঁটি কথাটি বলার সাহস পেলাম কীভাবে, সে প্রসঙ্গেই যাওয়া যাক। ছোট্ট একটি ঘটনা বলি। আমার এক বন্ধু বংশীয় পদবি হিসেবে তার নামের সঙ্গে লেখে ‘পাঠান’। তাকে দেখামাত্র আমার আরও কিছু বাঁদর বন্ধু আছে, যারা বলবেই বলবে, ‘পাঠান সাহেব, আপনি তো পাঠান। এক কাজ করেন, আমার হয়ে মলিকে কিংবা লাবণিকে একটা মেসেজ পাঠান না।’ কেউ কেউ বলবে, ‘আমি বিদেশে যেতে চাচ্ছিলাম। পাঠান সাহেব, আমাকে একটু বিদেশে পাঠান।’ আমাদের পাশের পাড়ায় আরেকটি ছেলে আছে। নাম সবুজ খান। তাকে দেখলেই ছেলেপেলেরা খ্যাপাবে, ‘তাই তো বলি, দিন দিন আমাদের দেশ থেকে সবুজ বিলীন হয়ে যাচ্ছে কেন। কারণ একটাই। আপনি সবুজ খান। মানে সবুজ খেয়ে ফেলেন।’ বংশের পরিচয় পাওয়ার পর ব্যবহারের ধরনটা কেমন হয় একটু তো পূর্বাভাস পাওয়া গেল, তাই না? পূর্বাভাসের পর এবার পশ্চিমাভাস-উত্তরাভাস-দক্ষিণাভাস সবই হবে। বংশ অনুযায়ী ব্যবহার করার বিষয়টি বোধ হয় সবচেয়ে বেশি মেনে চলে গ্রামের মানুষ। মনে করুন, কারও পূর্বপুরুষ অথবা পূর্বনারী পাগল ছিল। শহরের মানুষ হয়তো তার সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহারই করবে। কিন্তু গ্রামের মানুষ এই বংশীয় পরিচয়ের কারণে তার সঙ্গে এমন ব্যবহার করবে যে এই বেচারাকে হয়তো সারা জীবন কুমারই রেখে দেবে। কারণ তাদের একটি ধারণা, বংশের মধ্যে কেউ পাগল থাকলে এর প্রভাব কারও না কারও ওপর পড়বেই। বংশের পরিচয়ে তারা যে কারও সঙ্গে শুধু নেতিবাচক ব্যবহার করে তা-ই নয়, ইতিবাচক ব্যবহারও করতে জানে। কীভাবে, সেটা বলার আগে একটু স্মৃতিচারণা করে নিই। হাইস্কুলে পড়াকালে একটি বাংলা ছবি দেখেছিলাম। নামটি ঠিক মনে নেই। তবে ভিলেনের সেই বিখ্যাত ডায়লগটি খুব মনে আছে। স্মৃতিশক্তি ভালো হলে যা হয়। ভিলেন কথায় কথায় ডায়লগ দিত, ‘এই জানস, আমি রাজনীতি বংশের লোক।’ এটি বলার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের লোকজন নড়েচড়ে বসত। রাজনীতি বংশের লোক বলে তার প্রতি তাদের ব্যবহার মুহূর্তেই বদলে যেত। যদিও তখন বদলে যাওয়ার স্লোগান চালু হয়নি। তার মানে কেউ রাজনীতি বংশের লোক হলে তার প্রতি ব্যবহারটা করতে হবে অন্য রকম। শহরের মানুষ পরস্পরকে খুব কমই চেনে। গ্রামের মানুষ একজন আরেক জনকে একেবারে চৌদ্দগোষ্ঠীসহ চেনে তো, তাই তারা ব্যবহারটাও করে সেই অনুযায়ী। বিশেষ কোনো রাজনীতি বংশের না হোক, অন্তত চেয়ারম্যান বংশের লোক হলেই তারা অন্য রকম আদব-লেহাজ করে। অবশ্য না করে উপায়ও নেই তাদের। সহজ-সরল মানুষ। কোনো রকম গ্যাঞ্জাম বাধাতে চায় না। ওই সব বংশের লোকেরা আবার গ্যাঞ্জাম বাধানোর ওস্তাদ কি না! ‘জন্ম হোক যথা-তথা, কর্ম হোক ভালো’। অর্থাত্ বংশ যা-ই হোক না কেন, কর্ম বা ব্যবহারটা ভালো হতে হবে—এটি আপনি আমি মানলেও আমাদের দেশের রাজনীতি অঙ্গনে মানা হয় না। যদি মানা হতো, তাহলে আপনি আমিও এত দিনে দেশের প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট হয়ে যেতে পারতাম। এখানে মানা হয় কর্ম হোক যাহা তাহা জন্ম হোক ভালো; মানে—ভালো বংশে। আর এই নিয়মটিই চলে আসছে সেই স্বাধীনতার পর থেকে। যে কারণে আমাদের রাজনীতি বা সরকার গঠনের ব্যাপারটা বংশকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে পুরোপুরি। আগামী কয়েক যুগের মধ্যে আমরা এই ধারা থেকে বের হতে পারব বলে মনে হয় না। ইচ্ছে করলেই আমাদের পক্ষে এ দুই বংশের সদস্য হয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়, প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট হওয়াও সম্ভব নয়। বংশের পরিচয়ে ব্যবহারের ব্যাপারটা কোথায় নেই, বলুন। বছরের পর বছর জুতার তলা ক্ষয় করেও যখন চাকরি হয় না, তখন আমরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলি, ভাই রে, আমার তো আর মামা-চাচার জোর নেই যে চাকরি হবে। তো এই যে মামা-চাচার জোরের ব্যাপারটা, এখানেও কিন্তু বংশের বিষয় জড়িত। কারণ মামা-চাচা তো আর আকাশ ফুঁড়ে বের হয় না; বংশেই হয়। আপনার যদি ওই ক্যাটাগরির দু-একজন মামা-চাচা থাকে, তাহলে চাকরিদাতারাই আপনাকে স্যার স্যার করবে। আর অন্য প্রার্থীরা আপনাকে দিনে পাঁচবার সালাম দেবে। কারণ তাদের আশা একটাই, আপনার মামা-চাচার কল্যাণে যদি তাদের ভাগ্যের দরজা না হোক, অন্তত জানালাটা খোলে। জানালাও যদি না হয় যাতে ভাগ্যের ভেন্টিলেটরটা খোলে। জন্মের পর থেকেই আমরা শুনে আসছি একটা প্রবাদ—জাতের মেয়ে কালো ভালো। এখানেও বংশের জয়জয়কার। অর্থাত্ বংশ ভালো হলে মেয়ে কালো হলেও সমস্যা নেই। ক্রিম কিংবা বিউটি পারলারের কল্যাণে গায়ের রং ফরসা করা যাবে। কিন্তু জাত বা বংশ ঠিক করা যাবে না। বাপ-দাদার নাম ভাঙিয়ে খাওয়ার কাজটা আমরা প্রায় সবাই করে থাকি। এখানেও বংশের পরিচয় দিয়ে ভালো ব্যবহার পাওয়ার বাসনা। শুধু মানুষ কেন, পশুদের মধ্যেও জাত বা বংশের বিষয়টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আর এ জন্যই সাধারণ জাতের গাভীর প্রজনন ঘটানো হয় উন্নত জাতের ষাঁড়ের সঙ্গে। ব্যবহারে বংশের পরিচয় হোক আর বংশের পরিচয়ে ব্যবহার হোক—আমরা কোনোটার সঙ্গেই দ্বিমত পোষণ করব না, তবে আমাদের ছোটখাটো একটা প্রত্যাশা-আমড়া কাঠের ঢেঁকিরা যেন বংশীয় পরিচয়ের জোরে জাম বা কাঁঠাল কাঠের ঢেঁকির কদর না পেয়ে যায়। তাহলে এই ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানবে দূরের কথা, পৃথিবীতেই অকর্মা হয়ে যাবে।
ইকবাল খন্দকার
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০০৯
Leave a Reply