সাত দিন আগে থেকেই এক বন্ধুকে বলছিলাম, ‘ভাই, টিকিট কেটে না ফেললে তো বিপদ! একটা কিছু করা দরকার।’ বন্ধুটি আমার দুনিয়ার সব সমস্যার সমাধান খুব সহজে করে ফেলে।
সেবারও মুখ হাসি হাসি করে বলল, ‘কিচ্ছু ভাবিসনে। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। লোক আছে, টিকিট কেটে রাখবে।’
দেখতে দেখতে ‘শেষের সেই দিন’ চলে এল। ব্যাগ কাঁধে পড়ি-মরি করে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখি, আমার সেই বন্ধুর কোনো খোঁজ নেই। কথিত ‘আমাদের বাস’ ছেড়ে যাওয়ার ঘণ্টা আধেক পর বন্ধুবর হাঁপাতে হাঁপাতে হাজির, ‘আর বলিসনে। আমার সেই লোক ফাঁকি দিয়েছে। টিকিট তো পেলামই না, টাকাটাও জলে গেল।’
এখন? এখন কী হবে! এখন এই অকূল বাসস্ট্যান্ডে কে দেখাবে আমাদের ভরসার আলো, কে শোনাবে আশার বাণী? বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাবও তো আর নেই! এখন উপায়?
এই যে ঈদটা চলে গেল, তারই গপ্প করছি বুঝতেই পারছেন। আর কী? সেই থোড়-বড়ি-খাড়া, পায়ের বাত কমিয়ে বাড়ি ফেরা!
অবশ্য পায়ের বাত আমাদের কমাতে হলো না। কেবল ‘এর চেয়ে হেঁটে যাওয়া ভালো’ পর্যন্ত ভেবেছি, এর মধ্যে সত্যিকারের এক ‘মুশকিল আসান’ হাজির। থুঁতনির কাছে দাড়ি, কানে দুল, এমনকি বহু পকেটওয়ালা প্যান্টও পরা তার!
এহেন আধুনিক এক যুবক (বা তরুণ, বা কিশোর) দুলতে দুলতে এসে বলল, ‘বাগেরহাট যাবেন?’
‘জি ভাই। কোনো উপায় হয়?’
‘হয়। ৭০০ টাকা কইরা দিতে হবে।’
আমার বন্ধু কী যেন বলতে গিয়েছিল, দরদাম করতে চাচ্ছিল মনে হয়। আমি আর কথা বাড়াতে না দিয়ে ‘জি, দেব, দেব’ বলে রাজি হয়ে গেলাম।
এখন কি দরদামের সময়! একটা বাস পাওয়া গেছে, তাতে দুজনেরই আবার একটা করে আস্ত সিট!
কোথায় সিট? ভাই, আমাদের সিটটা কোথায়?—আমরা দুজন শুধু না; পুরো বাসজুড়ে তখন সিট নিয়ে মাতম শুরু হয়ে গেছে। তার মানে আমরা সিট পাব না?
এবার আমার বন্ধু কেরামতি দেখাল। সুপারভাইজারকে পাশে ডেকে নিয়ে কী যেন বলল আর হাতে কী যেন গুঁজে দিল (ঘুষ বলে সন্দেহ করবেন না)। একটু পর সুপারভাইজার এসে আমাদের ডেকে নিয়ে বাসে তুলল। বাসের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে আমরা আবার গাবতলী থেকে সায়েদাবাদ চলে যাচ্ছি মনে হলো।
না, অত দূর যাওয়ার আগেই বাসের শেষ প্রান্তে চলে এলাম। সেখানে বিশাল লম্বা একটানা একটা বেঞ্চ দেখিয়ে সুপারভাইজার বলল, ‘এই আপনেগো সিট।’
‘সিট কই! এ তো বেঞ্চ!’
বন্ধু বলল, ‘বেঞ্চও তো না। এ তো কাঠের চেয়ার!’
‘চেয়ারই তো থাকব। দেখেন না চেয়ার-কোচ লেখা আছে!’—সুপারভাইজার ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিল।
চেয়ারের কারিশমাটা খানিক পর বুঝলাম। আমরা বসে আছি সেই বেঞ্চের ডান দিকে। আর বাঁ দিকে বসেছেন চিকন গড়নের লম্বা দুজন ভদ্রলোক। বেঞ্চের মাঝে আরও দুজন!
চিকন লম্বা দুজনের ঠিক সামনের দুই সিটে এক প্রবীণ ও এক নবীন। নবীন ভদ্রলোক বাসের ওই নিভু নিভু আলোতেই চোখে চশমা সেঁটে কী একটা বই খুলে পড়ছেন। আহা, বড় ভালো লাগল। এমন করেই না বিদ্যাসাগর জন্মাবে দেশে।
কিন্তু বিদ্যাসাগরের কপাল খারাপ। খানিক পর পড়ার আরামের জন্য বেচারা তাঁর সিটে হেলান দিয়ে আয়েশ করে বসতে গিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ‘মড়াত্’!
ভেঙে পড়ে গেল বিদ্যাসাগরের সিটের পেছনের অংশটা। আর পড়বি তো পড় সেই চিকন লম্বা ভদ্রলোকের পায়ের ওপর। মড়াত্ শব্দ মেলাতে না-মেলাতেই চিকন লম্বা ভদ্রলোকের ‘বাবারে’ আর্তনাদে বাস কেঁপে উঠল। অবশ্য কাঁপুনিটা স্টার্ট নেওয়ারও হতে পারে।
বাস চলল, একই সঙ্গে চলল ‘সুপারভাইজার, সুপারভাইজার’ বলে চিত্কার। সুপারভাইজার ছুটে এসে কোনো সমাধান দিতে পারল না। সিটের বিচ্ছিন্ন অংশটা হেলে রইল ভদ্রলোকের হাঁটুর ওপর।
অবশেষে সমাধান হলো, বিদ্যাসাগর সারা রাত আর সিটে হেলান দিতে পারবেন না! বিদ্যাসাগর রাজি। কিন্তু তাঁর ঘুম তো আর এই চুক্তি মানে না।
রাত বেশ হয়েছে। বাস বেশ ছুটছে। একটু চোখ ধরে এসেছে। হঠাত্ চিত্কারে ঘুম ভেঙে গেল—ওরে বাবারে! ডাকাত পড়ল নাকি?
নাহ, আবার সেই চেয়ার। বিদ্যাসাগর ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, ফলে চেয়ারের পেছনের অংশটা আবার গিয়ে পড়েছে ভদ্রলোকের হাঁটুতে। এবার গণ্ডগোল লেগে গেল। এতক্ষণ চুপ করে থাকা চিকন লম্বা ভদ্রলোকের সঙ্গী এবার গর্জে উঠল,
‘ওই মিয়া! কথা বুঝ না? বলছি না হেলান দিবা না! এরপর হেলান দিলে জালনা দিয়া ফেইলা দিব।’
যদিও অত বড় ছেলেটাকে জানালা দিয়ে ফেলা যাবে কি না, তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ ছিল। কিন্তু ভয়েই কি না ছেলেটা বলল,
‘হেলান কি ইচ্ছে করে দেই? ঘুম আসে তো!’
‘ঘুমাবা না। আর ঘুমাইলে খবর আছে।’
ছেলেটা ভয়ে ভয়ে বলল, ‘কী খবর?’
‘কী খবর, সেটা ঝিনাইদহ গেলে টের পাবি।’
‘তোমার বাড়ি কি ঝিনাইদা নাকি? কোনো দিন দেহি নাই তো!’—এবার আরেকটা কণ্ঠ শোনা গেল। উঁকি দিয়ে দেখি বিদ্যাসাগরের পাশে বসা প্রবীণ ব্যক্তি জেগে উঠেছেন। দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘কী করবা ঝিনাইদা গেলে।’
‘গেলেই দেখবেন।’
‘আচ্ছা, চলো দেখি। আমিও জানি, কীভাবে মানুষ ঠান্ডা করতে হয়।’
‘আপনি কী জানেন?’
‘চল্ ঝিনাইদা, তারপর দেখবি। তোরে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলব।’—প্রবীণ ভদ্রলোক এবার তুইতে নামলেন।
গাড়ির সামনে থেকে একটা কণ্ঠ শোনা গেল, ‘চাচা, টুকরো টুকরো করে যদি কাটেনই, তাইলে আরেকটু সামনে যাইয়া কাইটেন।’
‘কেন, কেন?’
‘না, ওইখানে ভালো দা পাওয়া যায় তো। কাটতে সুবিধা হবে।’
এমন সময় মশকরা! ব্যস, শুরু হয়ে গেল হাতাহাতি। বাসের কেউ বাদ যাচ্ছে না। আমরাও দু-চারটে ফাও পেলাম।
প্রবল গণ্ডগোলের ধাক্কাতেই কিনা বাস থেমে গেল। কী ব্যাপার, কী ব্যাপার! বাস থামল কেন?
‘ইঞ্জিনে ঝামেলা করতেছে। এইখানে গ্যারেজ আছে। সকালে মেকানিক আসলে দেখাইয়া তারপর স্টার্ট দিতে হবে। ততক্ষণ গাড়ি যাবে না।’—বিরস বদনে জানিয়ে দিল সুপারভাইজার।
‘কী! গাড়ি যাবে না! ধর ড্রাইভাররে।’—নবীন, প্রবীণ, বিদ্যাসাগর, চিকন, লম্বা, খাটো, বেঁটে—সব দল এবার এক হয়ে ছুটল ড্রাইভারের দিকে।
আমাদের আর ছুটে কাজ নেই। আবার হয়তো ফাওটাই জুটবে!
দেবব্রত মুখোপাধ্যায়
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০০৯
Leave a Reply