ধানমন্ডির বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টসের দশম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ১৬ এপ্রিল শুরু হয়েছে ‘সৃজনে ও শেকড়ে’ শীর্ষক চিত্রকলা প্রদর্শনী। বাংলাদেশের আধুনিক শিল্প আন্দোলনের প্রারম্ভিক পর্যায়ের এবং পরবর্তীকালের ষাট ও সত্তরের দশকের ১০ জন শিল্পীর ৪০টি শিল্পকর্ম নিয়ে আয়োজন এ প্রদর্শনীর। সফিউদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়া, কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, হাশেম খান, রফিকুন নবী, মনিরুল ইসলাম, মাহমুদুল হক, শাহাবুদ্দীন আহমদ—এই ১০ জন শিল্পীর মধ্যে নয়জনের শিল্পকর্ম রচিত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। সফিউদ্দিন আহমেদের চারটি ছাপাই ছবি চল্লিশ থেকে ষাটের দশকের মধ্যে সৃষ্ট। তাঁর ‘মেলার পথে’ (উড এনগ্রেভিং, ১৯৪৭) ও ‘বন্যা’ (উড এনগ্রেভিং, ১৯৫৬) কাজ দুটি আলো-অন্ধকারের তারতম্যের মধ্য দিয়ে কিছুটা রোমান্টিক বাস্তববাদী রীতিতে সাধারণ মানুষের জীবনের চিত্রায়ন। লিফট গ্রাউন্ড একুয়াটিন্ট এচিংয়ে করা তাঁর অন্য দুটি ছাপাই ছবিতে করণকৌশলের নিরীক্ষাধর্মিতা, কালো, কমলা, নীল প্রভৃতি রঙের সংগতি এক বিভিন্ন আকৃতির রেখা দ্বারা স্পেসের বিভাজন দর্শকের চোখে পরিতৃপ্তি আনে। বিষয়বস্তুর বিমূর্ত উপস্থাপন এ ছবিগুলোর বৈশিষ্ট্য। শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়ার মৃদু রং ও টেক্সচার দিয়ে নির্মিত বিমূর্ত আঙ্গিকের ছবিগুলোতে (‘পেইন্টিং ব্লু’, ২০০৯ ও ‘আনটাইটেলড’ ২০১০) একটি কেন্দ্রাভিমুখী গতি তৈরি হয়েছে এবং মৃদু রঙের বিপরীতে বিভিন্ন ধরনের টেক্সচার অস্থিরতা, সংকট বা দ্বন্দ্বের আভাস জাগায়। এ ছাড়া টেক্সচারের ব্যবহার ছবিকে স্পর্শগ্রাহ্য বৈশিষ্ট্য দান করেছে।
শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর ছবিতে নিসর্গ ও গ্রামীণ মানুষের বিমূর্তায়ন ঘটেছে রূপের আলংকারিকধর্মী সরলীকরণের মধ্যে দিয়ে—নীল, সবুজ ও লালের প্রাধান্য কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সংস্কৃতিকে রূপায়িত করে। গাঢ় ও উজ্জ্বল রং ব্যবহারের তারতম্যের কারণে ছবিতে একাধিক তল সৃষ্টি হয়েছে, যা স্পেসের গভীরতা বৃদ্ধি করেছে।
মুর্তজা বশীরের চারটি ছবি তাঁর দুটি সিরিজকে প্রতিনিধিত্ব করছে—একটি প্রজাপতির পাখা, অন্যটি নারী ফিগার। পাখা সিরিজের কাজ দুটিতে কিছুটা ব্যতিক্রমী বিন্যাসরীতিতে ফর্মকে ক্যানভাসে বিন্যস্ত করা হয়েছে। ‘দুহিতা’ ও ‘মাই লেডি’ ছবি দুটি ২০০৩ সালে আঁকা। ফিগারের মনস্তত্ত্ব বা ব্যক্তিত্ব প্রকাশের চেয়ে পোশাক—শাড়ি, ব্লাউজ, কামিজ, ওড়না এবং এসব পোশাকের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী দাঁড়ানোর ভঙ্গি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ভিন্ন চরিত্র হলেও মুখের অভিব্যক্তি সব ফিগারে একই রকম। গৃহ-অভ্যন্তরের পটভূমিতে আঁকা ফিগারগুলো এক ধরনের অপ্রতিরোধী আবেদন তৈরি করেছে।
সৈয়দ জাহাঙ্গীরের সাম্প্রতিকতম সময়ে ছবিগুলো প্রকাশবাদী ঢঙে অনেক বেশি মূর্ত। গ্রামীণ কর্মজীবী মানুষ—কৃষক, জেলে, নদী, নৌকা, শস্যখেত, আকাশ প্রভৃতি বিষয় তাঁর ছবিতে এসেছে। তিনি যেভাবে রং প্রয়োগ করেছেন, তাতে ছবিগুলো কিছুটা সরল ও আদিম গুণ অর্জন করেছে। হাশেম খানের তীব্র ও উজ্জ্বল রঙের চারটি ক্যানভাস সহজেই দর্শকের দৃষ্টিকে উদ্দীপিত করে।
রফিকুন নবীর ‘কিং ফিশার’, ‘দি পোয়েট অব শিলাইদহ’, ‘ওম্যান অ্যান্ড ইয়োলো ফ্লাওয়ার’, ‘ফ্যামিলি’—এ চারটি ছবিই ২০১০ সালে আঁকা। চারটি ছবিতেই রূপের সংক্ষেপকরণ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন রেখার ব্যবহার, নীলের আধিক্য, রঙের মিতব্যয়িতা অলংকারধর্মিতা সর্বোপরি বিন্যাসরীতি মাধুর্য রচনা করেছে ক্যানভাসে। তাঁর ‘ফ্যামিলি’ ছবিটি বাবা, মা ও সন্তানের মধ্যে পরস্পর নির্ভরশীলতা, উষ্ণ ভালোবাসা ও মমত্ববোধের প্রকাশ। তিনটি সত্তা মিলে একটি অখণ্ড সত্তার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর এ ছবিতে; আঙ্গিকগত গুণ ও ভাবনা একে অন্যের পরিপূরক হয়েছে। ছোট সন্তানের হাতে একটি পাখি ছবির বিন্যাসরীতিতে আকর্ষণীয়ভাবে সম্পূর্ণতা এনেছে।
রং, রেখা ও টেক্সচার—এ তিনটি উপাদান মিলে কোমলভাবের ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে মনিরুল ইসলামের বিমূর্ত আঙ্গিকের ছবিতে। সম্পাদনের দিক দিয়ে তাঁর ছবি অনেক বিস্তৃত বা একাধিক তলের স্পেস সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে ভাবনার দিক দিয়ে একটি অসীম স্পেসকে ধরার প্রচেষ্টা লক্ষণীয়। ‘ওয়ে টু মেঘনা’ (২০১০), ‘ইভিনিং সঙ’ (২০১০) ছবিগুলোতে নদী, নৌকা, মানুষ অসীম স্পেসের মধ্যে প্রাণস্পন্দন ও স্বাজাত্যবোধ জাগায়। ছবিতে রং লেপন, রেখার ব্যবহার বা টেক্সচার তৈরি—সবই বিচক্ষণতা ও দক্ষতার পরিচয়বাহী।
মাহমুদুল হকের বিমূর্ত ক্যানভাসে স্পেস বিভাজিত হয়েছে রং ও টেক্সচারের মাধ্যমে উলম্ব ও আনুভূমিক গতির সংগতি তৈরি করে।
শাহাবুদ্দীনের কাগজের ওপর ফিগার ড্রইংগুলো বল, ক্ষমতা ও গতিকে প্রকাশ করে। ফিগারের অতিরঞ্জন এক ধরনের দুর্দমনীয় ভাব জাগায়। ভিন্নধর্মী এই ফিগারের উপস্থাপন শাহাবুদ্দীন আহমদকে একটি স্বতন্ত্র আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
প্রদর্শনী চলবে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ২৩, ২০১০
আবু বকর সিরাজী
chomotkar