বিবর্তনঃ দেবতাতন্ত্র থেকে গণতন্ত্র
মানত থেকে ইশতেহার
এখন গণতন্ত্রের যুগ। এ যুগে পলিটিশিয়ানদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির একমাত্র উৎস গণদেবতা। আর গণদেবতাকে তুষ্ট করার নাম নির্বাচনী ইশতেহার। দেবতাতন্ত্রের যুগে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সব শ্রেণী-পেশার মানুষের চাওয়া-পাওয়ার উৎস ছিল দেবতাকুল। আর তাদের তুষ্ট করার নাম ‘মানত’। গণতন্ত্রের যুগে নির্বাচন এলে রাজনীতিবিদেরা মোটা দাগে ওয়াদা করে হামেশা সেটা ভঙ্গ করে বলে শক্তিধর গণদেবতা এখন ভারি ক্ষুব্ধ। অথচ তারা একবারও ভাবে না, ভঙ্গ করার জন্য ওয়াদা করার বিদ্যা রাজনীতিবিদেরা গণদেবতার কাছেই হাতে-কলমে শিখেছে। এই তো, আমার নিজ গ্রামের সাদা-সরল কৃষক দেবতাতন্ত্রের যুগে মা কালীর কাছে ওয়াদা করে কেমন সরল নিয়মে সেটা সে ভঙ্গ করে বসল।
সে বছর ভরা বর্ষায় কৃষকের ছেলেটা অসুখে ভুগে একেবারে মরমর। দিশেহারা কৃষক সেদিন মা কালীর পায়ে মাথা কুটে বলল, ‘হে মা কালী, আমার ছেলেকে বাঁচিয়ে দে মা। আমি তোর পায়ে জোড়া মোষ বলি দেব।’
কৃষকের আকুল আবেদনে সাড়া দিয়ে মা কালী বললেন, ‘তথাস্তু।’ মা কালীর দোয়ায় কৃষকের ছেলে তক্ষুনি দিব্যি সুস্থ। নিশ্চিন্ত-নির্ভার কৃষক মনের সুখে খায়দায়, দোল উৎসবে যাত্রা দেখে বেড়ায়; কিন্তু জোড়া মোষ বলির নামটিও মুখে আনে না। মা কালী তো আমার দেশের গণদেবতার মতো বেভুলো আলাভোলা মানুষ নন। আপসে মানত আদায়ের আশায় কিছুদিন অপেক্ষা করে কুপিত মা কৃষকের ঘুমের রাজ্যে হানা দিয়ে বলেন, ‘ও রে নরাধম, তোর জোড়া মোষ বলির খবর কী?’
ভয় পেয়ে ঘুম চটকে থতোমতো কৃষক খানিক থিতু হয়ে বলে, ‘মা গো, আমি গরিব মানুষ। জোড়া মোষ কোথায় পাব? অনুমতি করো মা, সামনের ঘোর অমাবস্যার রাতে তোমার থানে জোড়া পাঠা বলি দেব।’
মা কালী দয়ার বশে বলেন, ‘তথাস্তু।’ এদিকে অমাবস্যা গড়িয়ে শুক্লপক্ষও শেষ হওয়ার পথে। কৃষকের জোড়া পাঠা বলির কোনো লক্ষণ নেই। মানত আদায়ে অনড় মা কালী ফের স্বপ্নে দেখা দিয়ে কৃষককে চোখ রাঙাতেই কৃষক একবুক সাহস নিয়ে গলা তুলে বলে, ‘জোড়া পাঠার দাবি ছেড়ে দে মা। ওসব এখন স্বপ্নে পোলাও খাওয়ার মতোই অবাস্তব। বাস্তবে খুব খেটেখুটে তোকে এক জোড়া পায়রা দিতে পারি। এর বেশি আমি অপারগ।’ তিতিবিরক্ত মা কালী বেজার মুখে বলেন, ‘বেশ। তুই সেটাই দে।’
রাত পোহালে জোড়া পায়রা বলির কথা বেমালুম ভুলে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াতে থাকে কৃষক। ক্ষুব্ধ দেবী কৃষককে ফের স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেন, ‘কি রে নচ্ছার! আমার জোড়া পায়রার খবর কী?’
মা কালীর বোকামি দেখে কৃষক এবার চোখ মটকে রাজনৈতিক হাসি হাসে। বলে, ‘ধানের দামের বেহাল দশা, মা। তায় আবার বিশ্বমন্দা। জোড়া পায়রার বদলে তোমার পায়ে এক জোড়া ফড়িং বলি দিই। সময়ের মন্দ গতিক বুঝে তুমি ওটাকেই জোড়া মোষ বলে ধরে নিয়ো, মা।’
কৃষকের ছলাকলায় নিরুপায় মা কালী ক্লান্ত গলায় বিষণ্ন সুরে বলেন, ‘তথাস্তু।’
যথারীতি দিন গড়িয়ে মাস কাবার। তুচ্ছ জোড়া ফড়িং বলি দেওয়ার কথাও কৃষক বেমালুম ভুলে বসে থাকে। কৃষকের রাজনৈতিক আচরণে দেবী এবার সত্যি তিতিবিরক্ত। অগ্নিমূর্তি মা কালী আবার কৃষকের সুখের ঘুমে হানা দিয়ে চড়া গলায় বলেন, ‘ও রে অকৃতজ্ঞ, নরাধম। তোর হাত থেকে তুচ্ছ জোড়া ফড়িং বলি পাওয়ার আশায় আমি আর কত কাল পথ চেয়ে বসে থাকব?’
কাঁচা ঘুমে হুটহাট ধাক্কাধাক্কিতে মহা বিরক্ত কৃষকও আজ মরিয়া। দেবতার জ্বালাতন বলে সে মেলা সয়েছে-আর কত? চোখ থেকে ঘুম তাড়িয়ে দাঁত-মুখ খিচে কৃষক বলে, ‘তুমি কি চোখের মাথা খেয়েছ, মা? চোখের সামনে হাজার ফড়িং ডানায় রোদ মেখে ঘাসের ডগায় নাচে-গায়। একটু গা নেড়ে খপ করে ধরে দুটো মুখে পুরবে-এ কথা তোমাকে হাতে ধরে শিখিয়ে দিতে হবে?’ কৃষকের চোখ রাঙানিতে সেদিন দেবতাতন্ত্রের অবসান-গণতন্ত্রের সূচনা।
গণতন্ত্রের যুগে পলিটিশিয়ানরা নির্বাচনের নিদানে গণদেবতার পায়ে পদ্মাসেতু মানত করতেই পারে। নির্বাচনে জেতার পরে মানতের কথা ভুলে গেলে ওদের ওপর খেপে ওঠা গণদেবতার ভারি অন্যায়। মা কালী অমর দেবতা হয়ে যদি মানতের ফড়িং নিজের হাতে ধরে খেতে পারেন তাহলে মাটির ওপর দুই পায়ে চরে খাওয়া রক্ত-মাংসের গণদেবতা নিজেই পদ্মার ওপর দু-চারটা বাঁশ ফেলে সাঁকো বেঁধে চলাচল করবে-এতে আপত্তি কোথায়?
তুষার কণা খোন্দকার
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ০৭, ২০০৯
Leave a Reply