অনাগতের সঙ্গে আলাপ
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
আমার মেয়ে: আত্মজার সঙ্গে কথোপকথন—মার্জিয়া লিপি \ ফেব্রুয়ারি ২০১০ \ মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা \ প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ \ ৭২ পৃষ্ঠা \ ১০০ টাকা
বেশ কিছুদিন আগে প্রথম আলোর ‘নারীমঞ্চে’ জন্মের অপেক্ষায় থাকা মেয়ের সঙ্গে মার্জিয়া লিপির কথোপকথনের কিছু অংশ ছাপা হয়েছিল। সেগুলো একটা কৌতূহলবোধ থেকে পড়েছিলাম। মনে আছে, বিদেশে এক বইয়ের দোকানে একবার ইতালির প্রখ্যাত সাংবাদিক ওরিয়ানা ফালাচির লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন নামের উপন্যাসটি উল্টেপাল্টে দেখেছিলাম, যাতে হঠাৎ গর্ভবতী হয়ে পড়া কর্মজীবী এক নারী (আসলে তিনি নিজেই) তাঁর অনাগত সন্তানের সঙ্গে কথা বলেন এবং এই কথাবার্তার মধ্য দিয়ে সন্তানের বেঁচে থাকার সব প্রতিবন্ধকতা শনাক্ত করেন। শুনেছি উপন্যাসটি শক্তিশালী, কিন্তু কেনা হয়নি বলে পড়া হয়নি।
অনাগত সন্তানের সঙ্গে মার্জিয়ার কথোপকথন কোনো উপন্যাস নয়, বরং নয়টি কঠিন মাসের সন্তান জন্মের পুরো একটি আবর্তনের দিনপঞ্জি। কিন্তু মার্জিয়ার লেখার ভাষা, তাঁর অনুধাবন ও প্রকাশের শক্তি, তাঁর সময় ও কাল-দর্শন মোটেও কম শক্তিশালী নয়।
বইটি আমি সময় নিয়ে পড়লাম। জানলাম যে সেই সন্তানটির বয়স এখন পাঁচ, কিন্তু এই উল্লেখটি অপ্রয়োজনীয়। যাঁরা বইটি পড়বেন, তাঁদের কাছে বরং ওই নয় মাসের গল্পটিই জরুরি।
২০০৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০০৪ সালের আগস্টের প্রায় প্রতিটি সপ্তাহের একটি বা দুটি দিনের বিবরণের মধ্য দিয়ে মার্জিয়া সন্তানকে কখনো শোনাচ্ছেন বঙ্গীয় ইতিহাস, কখনো কাহলিন জিব্রানের দর্শন। কখনো আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীর কথা। শোনাচ্ছেন স্বাধীনতার, মার্চের, পতাকার গল্প, বাংলা সাহিত্যের কোনো চরিত্র অথবা কবিতা অথবা পয়লা ফালগুনের কাহিনি। তালিকায় আরও আছে পাখি উৎসব, ইরাক যুদ্ধ, একাত্তরের দিনগুলি, সমাজবঞ্চিতদের জন্য সুনীতা কৃষ্ণাণের উদ্যোগ, বৈচিত্র্য ও ভূ-দৃশ্য, নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। না, এসব বিবরণে কোনো কাঠিন্য নেই, পাণ্ডিত্যের ভাব নেই, শব্দের বাহুল্য নেই; আছে এক অন্তরঙ্গ, সপ্রাণ অন্তর্লোকন।
মার্জিয়ার বর্ণনার কেন্দ্রে তাঁর সন্তান; তিনি জেনেছেন যে সেটি মেয়েশিশু হবে, যাকে তিনি ডাকছেন রাজকন্যা বলে। তাকে মার্জিয়া জানান তাঁর নিজের বিপন্নতার কথা, সমাজের অচলায়তনগুলোর কথা, তাঁর নানা আনন্দ-হতাশা-নিরাবেগের কথা। তাঁর একটি সন্তান ফালাচির নেভার বর্ন চাইল্ডের মতো জন্মের আগেই মারা গিয়েছিল। সে জন্য মার্জিয়া খুব ভয়ে ছিলেন। কিন্তু ডাক্তারের নির্দেশ মেনে চলেছেন অক্ষরে অক্ষরে। সন্তানকে তিনি জানাচ্ছেন কোন সপ্তাহে ভ্রূণের কী উন্নতি, কী অগ্রগতি। তাঁর বর্ণনাটি ডাক্তারি বিদ্যা-শুদ্ধ; অনেক তথ্য তিনি দিয়েছেন ইন্টারনেট ঘেঁটে। কিন্তু ডাক্তারি বিদ্যার প্রকাশ নয়, বরং খুবই গহিন একটি মানবিক টান থেকে তিনি হাজির করেছেন তাঁর তথ্যগুলো। যেন তারা একটি পরিপূর্ণ ভ্রূণচক্রের সঙ্গে সম্পর্কিত আশা-আকাঙ্ক্ষা, আবেগ-উদ্বেগকে প্রকাশ করে, কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্যে অনিবার্যতাকে নয়।
মার্জিয়ার দিনপঞ্জির শিরোনামগুলো বিচিত্র, সেগুলো জানান দেয় সন্তান নিয়ে এবং জগৎসংসার নিয়ে তাঁর নানাবিধ চিন্তার। দিনপঞ্জিগুলো কখনো কবিতা, কখনো বর্ণনা, কখনো আত্মকথন, কখনো দর্শন। একটি শিরোনাম ‘পেটের দাগ’ আরেকটি ‘কৃষ্ণচূড়ার ইচ্ছে’; একটি ‘স্কুলের বাসনা দিদি’, আরেকটি ‘প্রজাপতির পাখনা মেলা’। এই শেষ শিরোনামে লিখেছেন, ‘আজ প্রথম শরীরে, তোমার অন্যরকম অস্তিত্ব-নড়াচড়া অনুভব করলাম।’ নির্ঝর নৈঋত’-এ লিখেছেন ‘এ সময়ে একটু বেশি গরম লাগে, কারণ গর্ভস্থ ভ্রূণ নিজের শরীরের তাপ তার মায়ের গায়ে ছড়িয়ে দেয়।’ একটু পরেই বর্ণনা দিচ্ছেন, শীতলক্ষ্যায় নৌকায় রাতে ঘুরে বেড়ানোর গল্প, যেখানে মার্জিয়া বলে যাচ্ছেন নিজের জীবনের এক সুন্দর স্মৃতির কাছে। মার্জিয়ার সন্তানটির নাম ভোর, স্বামীর নাম সূর্য। সূর্যকে আমি চিনি, কিন্তু মার্জিয়ার বর্ণনায় হঠাৎ হঠাৎ তাঁর ওপর অভিমান হতেও দেখি ‘ইচ্ছার ঈশ্বর সে, তাকে আমি ঠিক বুঝি না’—এরকম কথাও বলেন। মাতৃত্ব শুরু কঠিন একটি কাল, চেনাজানার সহজতার ওপর একটা কষ্টের প্রলেপ তা ফেলে দেয়। সূর্যকে নিয়ে অবশ্য তাঁর উচ্ছ্বাসও আছে, সন্তানকে নিয়ে যেমন।
আমার মেয়ে একটি মেয়ের ভ্রূণ থেকে মানুষ হিসেবে জন্মানোর নয় মাসের ইতিহাস শুধু নয়, এটি মার্জিয়ার বহুদর্শন, সমাজ ও সময় দর্শন এবং দুঃসময় প্রতিকূল সমাজব্যবস্থা, মানুষকে বিপন্ন করা যান্ত্রিকতার, মানুষে মানুষে সম্পর্কের জটিলতার একটি বিশুদ্ধ প্রকাশও বটে। মার্জিয়ার বলার সুরটিতে আছে একসঙ্গে অনেক বোধ অনুভূতির সমাবেশ। কিন্তু সব ছাপিয়ে বাজতে থাকে এক অন্তরঙ্গ আলাপের সুর।
বইটির যে দ্বিতীয় সংস্কারণ বেরুচ্ছে, তা নিশ্চয় এর পাঠকপ্রিয়তা প্রমাণ করে। এবং এটি যে শুধু মা হতে যাচ্ছেন তেমন পাঠক পড়ছেন তা নয়, পড়ছেন সব বয়সের অনেকেই।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ২৩, ২০১০
Leave a Reply