ইরান দেশের এক সওদাগরের ছিল একটি ভারতীয় তোতা। সে তোতা জ্ঞানে বৃহস্পতি, রসে কালিদাস, সৌন্দর্যে রুডলফ ভেলেন্টিনো, পাণ্ডিত্যে ম্যাক্সম্যুলার। সওদাগর তাই ফুরসত পেলেই সেই তোতার সঙ্গে দু-দণ্ড রসালাপ, তত্ত্বালোচনা করে নিতেন।
হঠাৎ একদিন সওদাগর খবর পেলেন ভারতবর্ষে কার্পেট বিক্রি হচ্ছে আক্রা দরে। তখনই মনস্থির করে ফেললেন ভারতে যাবেন কার্পেট বেচতে। জোগাড়-যন্ত্র তদ্দণ্ডেই হয়ে গেল। সর্বশেষে গোষ্ঠীকুটুমকে জিজ্ঞেস করলেন, কার জন্য হিন্দুস্তান থেকে কী সওদা নিয়ে আসবেন। তোতাও বাদ পড়ল না-তাকেও শুধালেন সে কী সওগাত চায়। তোতা বলল, ‘হুজুর, যদিও আপনার সঙ্গে আমার বেরাদরি, ইয়ারগিরি বহু বৎসরের, তবু খাঁচা থেকে মুক্তি চায় না কোন চিড়িয়া? হিন্দুস্তানে আমার জাতভাই কারোর সঙ্গে যদি দেখা হয় তবে আমার এ অবস্থার বর্ণনা করে মুক্তির উপায়টা জেনে নেবেন কি? আর তার প্রতিকূল ব্যবস্থাও যখন আপনি করতে পারবেন, তখন এ সওগাতটা চাওয়া তো কিছু অন্যায়ও নয়।’
সওদাগর ভারতবর্ষে এসে মেলা পয়সা কামালেন, সওদা কেনা হলো, কিন্তু তোতার সওগাতের কথা গেলেন বেবাক ভুলে। মনে পড়ল হঠাৎ একদিন এক বনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় একঝাঁক তোতা পাখি দেখে। তখনই তাদের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, ‘তোমাদের এক বেরাদর ইরান দেশের খাঁচায় বন্দী হয়ে দিন কাটাচ্ছে। তার মুক্তির উপায় বলে দিতে পারো?’ কোনো পাখিই খেয়াল করল না সওদাগরের কথার দিকে। শুধু দুঃসংবাদটা একটা পাখির বুকে এমনই বাজ হানল যে সে তৎক্ষণাৎ মরে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। সওদাগর বিস্তর আফসোস করলেন নিরীহ একটি পাখিকে বেমক্কা বদখবর দিয়ে মেরে ফেলার জন্য। স্থির করলেন, এ মূর্খামি দু-বার করবেন না। মনে মনে নিজের গালে ঠাস-ঠাস করে মারলেন গণ্ডা দুই চড়।
বাড়ি ফিরে সওদাগর সওদা বিলালেন দরাজ হাতে। সবাই খুশ, নিশ্চয়ই ‘জয় হিন্দ’ বলেছিলেন ব্যাটা-বাচ্চা সবাই। শুধু তোতা গেল ফাঁকি-সওদাগর আর ও-ঘরে যান না পাছে তোতা তাঁকে পাকড়ে ধরে সওগাতের জন্য। উঁহু, সেটি হচ্ছে না, ও খবরটা যে করেই হোক চেপে যেতে হবে।
কিন্তু হলে কি হয়-গোঁফ কামানোর পরও হাত ওঠে অজান্তে চাড়া দেওয়ার জন্য (পরশুরাম উবাচ), বে-খেয়ালে গিয়ে ঢুকে পড়েছেন হঠাৎ একদিন তোতার ঘরে। আর যাবে কোথায়-অস-সালাম আলাই কুম ও রহমত উল্লাহি, ও বরকত ওহু, আসুন আসুন, আসতে আজ্ঞে হোক। হুজুরের আগমন শুভ হোক ইত্যাদি ইত্যাদি, তোতা চেঁচাল। সওদাগর ‘হেঁ হেঁ’ করে গেলেন! মনে মনে বললেন, খেয়েছে!
তোতা আর ঘুঘু এক জিনিস নয় জানি, কিন্তু এ তোতা ঘুঘু। বললে, ‘হুজুর, সওগাত?’ সওদাগর ফাটা বাঁশের মধ্যিখানে। বলতে পারেন না, চাপতেও পারেন না। তোতা এমনভাবে সওদাগরের দিকে তাকায় যেন তিনি বেইমানস্য বেইমান। সওগাতের ওয়াদা দিয়ে গডড্যাম ফক্কিকারি! মানুষ জানোয়ারটা এই রকমই হয় বটে! তওবা, তওবা! কী আর করেন সওদাগর। কথা রাখতেই হয়। দুম করে বলে ফেললেন।
যেই না বলা, তোতাটি ধপ করে পড়ে মরে গেল। তার একটা বেরাদর সেই দূর হিন্দুস্তানে তার দুরবস্থার খবর পেয়ে হার্টফেল করে মারা গেল, এ রকম একটা প্রাণঘাতী দুঃসংবাদ শুনলে কার না কলিজা ফেটে যায়?
দিলের দোস্ত তোতাটি মারা যাওয়ায় সওদাগর তো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। ‘হায়, হায়, কী বেকুব, কী বে-আক্কেল আমি। একই ভুল, দু-বার করলুম।’ পাগলের মতো মাথা থাবড়ান সওদাগর। কিন্তু তখন আর আফসোস, ফায়দা নেই-ঘোড়া চুরির পর আর আস্তাবলে তালা মেরে কি লভ্য! সওদাগর চোখের জল মুছতে মুছতে খাঁচা খুলে তোতাকে বের করে আঙিনায় ছুঁড়ে ফেললেন।
তখন কী আশ্চর্য, কী কেরামতি! ছুড়ে ফেলতেই তোতা উড়ে বসল গিয়ে বাড়ির ছাদে। সওদাগর তাজ্জব-হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন তোতার দিকে। অনেকক্ষণ পরে সংবিত ফিরে শুধালেন, ‘মানে?’ তোতা এবার প্যাঁচার মতো গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘হিন্দুস্তানি যে তোতা আমার বদনসিবের খবর পেয়ে মারা যায়, সে কিন্তু আসলে মরেনি। মরার ভান করে আমাকে খবর পাঠাল, আমিও যদি মরার ভান করি, তবে খাঁচা থেকে মুক্তি পাব।’
সওদাগর মাথা নিচু করে বললেন, ‘বুঝেছি, কিন্তু বন্ধু, যাওয়ার আগে আমাকে শেষ তত্ত্ব বলে যাও। আর তো তোমাকে পাব না।’
তোতা বলল, ‘মরার আগেই যদি মরতে পারো, তবেই মোক্ষলাভ। মড়ার ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই, মান-অপমান বোধ নেই। সে তখন মুক্ত, সে নির্বাণ মোক্ষ সবই পেয়ে গিয়েছে। মরার আগে মরার চেষ্টা করো।’
[সংক্ষেপিত]
সৈয়দ মুজতবা আলীঃ প্রখ্যাত রম্যসাহিত্যিক। তোতা কাহিনী আড্ডার মেজাজে লেখা।ফলে গল্পের সঙ্গে মিশেছে সুমিষ্ট মশকরা, তত্ত্বকথার চাটনি আর বিদ্যার বৈভব। তাঁর জন্ম ১৯০৪ ও মৃত্যু ১৯৭৪ সালে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ৩১, ২০০৯
Leave a Reply