তুমি তো ডাক্তারি পড়ছ, তাই না? এত বড় ঘরে শব্দগুলো ভীষণ প্রতিধ্বনির সৃষ্টি করে। ইকোসিস্টেমের বারোটা বাজানো এক সাউন্ড সিস্টেম আমার ঠিক মাথার ওপর। বক্তা আমার কাছ থেকে প্রায় ২০ ফুট দূরে তাঁর ডেস্কে বসা। কথা বলছেন একটা মাইক্রোফোনে। সেটা আবার তাঁর টাইয়ের সঙ্গে লাগানো।
-জি, পড়েছিলাম, তবে শেষ করতে পারি নাই।
-তা কেন পার নাই সেটা তো বুঝতে পারতেছি। জলের মতো সব পরিষ্কার। সোয়াইন ফ্লু নিয়া রিপোর্টটা কার?
-জি, ওইটা তো ফারুক ভাইয়ের লেখা।
-ফারুক তো লিখছে জানি, কিন্তু সে তো বলল তুমি নাকি সব ইনফরমেশন তারে সাপ্লাই দিছ।
সাউন্ড সিস্টেমের কারণেই কিনা কথাগুলো বেশ চিবানো শোনাচ্ছে। বজলু ভাই রেগে আছেন কি না বোঝার উপায় নেই। কারণ, বাতি জ্বলছে আমার মাথার ওপর, তাঁর টেবিলে অন্ধকার। মনে হচ্ছে ইন্টারোগেশন রুমে আছি। এখন প্রশ্নটার জবাব কী দেব বুঝতে পারছি না। ফারুক ভাই আমার খুব কাছের মানুষ। প্রায়ই চা-সিগারেট খাওয়ান, টাকা-পয়সা ধারটার দেন। স্বাস্থ্য বিট করেন। আমার বেশ কজন সহপাঠী ও বড় ভাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ বেশ কিছু বড় পোস্টে আছে। তাই এই খাতির। কদিন আগে আমাকে ধরলেন যে তাঁকে একটা স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছে সোয়াইন ফ্লু নিয়ে। প্যানডেমিক এইচওয়ানএনওয়ান ভাইরাস, শূকর থেকে ছড়ায়। এ ব্যাপারে তেমন কিছু জানা নেই, নেট ঘেঁটে কিছু তথ্য দিয়েছিলাম তাঁকে। এমনিতে ফারুক ভাই ব্লান্ডার তেমন করেন না, করার সুযোগ নেই বলে। কারণ, বেশির ভাগ সময় প্রেস কনফারেন্সের কাগজটাই কম্পোজের পর হালকা এডিট করে তিনি ধরিয়ে দেন নিউজ এডিটরকে। সেগুলো ছাপাও হয় বাইলাইনে-তাঁর নামে। একবারই শুধু ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্বাস্থ্যসচিব’ লিখে একটু ঝামেলায় পড়েছিলেন। স্বাস্থ্যসচিব একজনই থাকেন, আর তাঁর নাম প্রকাশ না করলেও পদবি প্রকাশ করলেই নাম জানা যায়। তবে সেটাও অনেক আগের কথা।
এসি রুমে ঘামতে ঘামতে আমার মুখ থেকে কোনোমতে জি বের হয়। কানে সেটা চিঁ করেই বাজে। বজলু ভাইয়ের পরের প্রশ্ন, তুমি কি জানো সোয়াইন ফ্লু সম্পর্কে? কীভাবে বুঝবা? এর প্রিভেনশন কী?
-ইয়ে মানে, সর্দি-কাশি-হাঁচি টাইপের রোগ। ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো। শাকসবজি আর ভিটামিন সি বেশি করে খেতে হয়। নিয়মিত ব্যায়াম করতে হয়।
-থামো মিয়া। এসব ক্লাস ওয়ান-টুর পোলাপাইনও জানে। জ্বর হইলে প্যারাসিটামল আর পেটে গ্যাস হইলে এন্টাসিড। এ জন্য এই দেশে সার্টিফাইড ডাক্তারের থিকা তোমার মতো ডাক্তার বেশি। সবাই সব রোগের ওষুধ জানে। ফারুকরে তুমি ডিকটেশন দিছ এইটা নিয়া? কী কইছ সেইটা কও।
-মানে, বজলু ভাই, বেশি কিছু তো আমি জানি না, যা জানি তা-ই বলেছি।
-আচ্ছা! এইবার বলো সাভারে শূকরের ফার্ম হইল কবে থিকা। কবে থিকা শূকর ডিম পাড়া শুরু করল। আর কবে সেখানকার শূকর ব্যবসায়ীরা গর্ত খুঁইড়া সব শূকর পোড়াইয়া মারল?
বলে কি! পেছনে দেয়াল থাকায় চেয়ার উল্টে পড়ি না আমি। হতভম্ব হয়ে আমি বজলু ভাইয়ের স্টাইলে বলে উঠি, ঈমানে না, এসব তারে আমি কখ্খ্নো বলি নাই। ফারুক ভাই মিথ্যা কথা কইছে আপনারে।
-তাই, না! দেশে সোয়াইন ফ্লু বিস্তার লাভ করায় সাভারের সব শূকর ব্যবসায়ী তাদের ফার্মের সব শূকরের ডিম নষ্ট করে ফেলছে আর আক্রান্ত শূকরগুলো গর্ত খুঁইড়া পোড়াইয়া মারছে, এইটা তুমি বলো নাই?
-না, বজলু ভাই। জীবনেও না।
-তাইলে কী বলেছ? সে এসব লেখল ক্যান? সে তো কাইন্দাকাইটা কসম কইরা বলল, সে তোমার কথার ওপর ভিত্তি কইরাই এসব লিখছে।
এবার আমি সত্যি ভড়কাই। আর সত্যিটাও আমার কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। ফারুক ভাইয়ের ভ্যানভ্যানানিতে অস্থির হয়ে বলেছিলাম যে সিম্পটমগুলো সব এরকম-ওরকম। বাকিটা ওই বার্ড ফ্লুর মতোই। ফারুক ভাইও তাঁর ভিত্তিতে পোলট্রি ফার্মের মুরগির জায়গায় শূকর বসিয়ে দিয়েছেন! এই রিপোর্ট ছাপা হয়ে গেছে নাকি!!
বজলু ভাই অভিজ্ঞ সম্পাদক। আমার মনের কথা ঠিক বুঝে নেন অভিব্যক্তি দেখে। বলেন, ‘রিপোর্টটা আমি দেখছি বইল্যা বাঁচছো। ছাপানো হইলে তোমাগো দুইজন যেন জীবনেও কোনো পত্রিকায় চাকরি করতে না পারো সেই ব্যবস্থা করতাম। ফারুক আমার পুরান লোক, ওরে এক মাসের ছুটি দিছি। তুমিও যাও। অফিসে ঢুইক্যাই আমারে তোমার চেহারা দেখতে হয়। আর আগামী এক মাস আমি হাই ব্লাডপ্রেশার নিয়া অফিস করতে ইচ্ছুক না। আমি কাগজে সই কইরা দিছি, তুমি নাম আর কারণটা বসাইয়া ঐচ্ছিক ছুটি কাটাইয়া আসো কয় দিন।’
পুরো ব্যাপারটা শাপে-বর হলো কি না বুঝতে পারছি না। আলম ভাইয়ের টেবিলে ছুটির দরখাস্তটা জমা দিই। কারণের জায়গায় লেখি ‘সোয়াইন ফ্লু অবকাশ’।
অমি রহমান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ৩১, ২০০৯
Leave a Reply