মামা সব সময়ই প্রচণ্ড শব্দ করে হাঁচি দেন। হাঁচির সময় মামার কাছাকাছি থাকলে প্রচণ্ড শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আমার ধারণা, এই বিকট হাঁচির কারণেই তার ঘরের দেয়ালে ফাটল ধরতে শুরু করেছে। আমি তাঁকে বহুবার বুঝিয়েছি যে মামা, এত জোরে হাঁচি দেওয়া ঠিক না। এমনিতেই বাবার হার্টের অসুখ। দেখা যাবে হাঁচির শব্দেই তাঁর হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। মামা অবাক হয়ে বলেন, হাঁচি কি মেপে দেওয়া যায় নাকি? তুই এক কাজ কর, আমার ঘরটা সাউন্ড প্রুফ করে দে, তাহলে আর তোদের ডিস্টার্ব হবে না। মামার সঙ্গে তর্ক করতে যাওয়া বোকামি। তার পরও মামার ঘরে গিয়ে বললাম, তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।
কী কথা?
দেশে সোয়াইন ফ্লু দেখা দিয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই তা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
তো, আমি কী করব? সোয়াইন ফ্লুকে আসতে মানা করব?
এত কষ্ট তোমাকে করতে হবে না। তুমি শুধু মুখ ঢেকে হাঁচি দিয়ো। এ রোগ হাঁচি-কাশির মাধ্যমে বেশি ছড়ায়। আর মুখ ঢেকে হাঁচি দিলে আমাদের কান একটু বিশ্রাম পাবে।
তুই কি আমাকে জ্ঞান দিতে এসেছিস? দু-একটা আউট বই পড়ে খুব জ্ঞান হয়েছে, তাই না? সোয়াইন ফ্লু বানান জানিস?
জানব না কেন, দন্তস্য ওকার···
খামোশ! বাংলা বানান করছিস কোন ভরসায়? এটার উৎপত্তি হয়েছে মেক্সিকোতে। মেক্সিকান ভাষায় বানান কর।
মামা! মেক্সিকান ভাষা আমি জানব কীভাবে?
না জেনে কাউকে জ্ঞান দিতে আসবি না। ছাগল কোথাকার, সোয়াইন ফ্লু বানান পারে না, যা ভাগ!
আমি গোমড়া মুখে নাশতা খেতে বসলাম। সবাই সোয়াইন ফ্লু নিয়ে আলোচনা করছে। মামা এসে আমার পাশের চেয়ারটায় বসে গম্ভীর মুখে বাবাকে বললেন,
দুলাভাই, আপনার গুণধর পুত্র যে লেখাপড়া কিছু করে না, এই তথ্য কি আপনি জানেন?
লেখাপড়া করে না মানে? কী করে ও?
মানুষকে উপদেশ দিয়ে বেড়ায়। সে বলে আপনি নাকি দুর্বল চিত্তের অধিকারী, সামান্য হাঁচির শব্দেই নাকি আপনার হার্টে মেজর অ্যাটাক হতে পারে। তাই মুখ ঢেকে হাঁচি দিন, জীবন বাঁচান-এ ধরনের উপদেশ। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, ও সোয়াইন ফ্লু বানান পারে না। বিষয়টা একবার ভেবে দেখুন, দুলাভাই, এতবড় ছেলে, সে সোয়াইন ফ্লু বানান পারবে না?
বাবা আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, তুই দূরে বসেছিস বলে চড় দিতে পারছি না। কাল থেকে আমার কাছাকাছি বসবি। কষে চড় না দিলে তুই সোজা হবি না।
আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। এই বাসায় ভালো কোনো কিছুর দাম নেই। এ জন্যই মাঝে মাঝে এ সংসার ছেড়ে রাজকুমার সিদ্ধার্থের মতো বনে চলে যেতে ইচ্ছে করে।
বাবা মামাকে বললেন, জামিল, দেশে তো সোয়াইন ফ্লু মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে। আমরা যাতে সুস্থ থাকি সে ব্যবস্থা করো। ওই মুখোশ-টুখোশ যা লাগে তোমাকেই কিনতে হবে। তুমি ছাড়া এ বাড়িতে তো আর কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী নেই।
মামা আস্ত একটা ডিম শেষ করে বললেন, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না, দুলাভাই। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই সব ব্যবস্থা করে ফেলছি।
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই এখানে বসে আছিস কেন? যা, পড়তে বস। আর শোন, ‘বাংলাদেশে নবাগত সোয়াইন ফ্লু ও এর প্রতিকার’-এ বিষয় নিয়ে ইংরেজিতে একটা রচনা লিখে আন। ৩৫ মিনিট সময়।
কী বিপদ! এমনিতেই মুখস্থ না করে রচনা লিখতে পারি না, তার ওপর কী কঠিন এক বিষয়। সোয়াইন ফ্লুর প্রতিকার নিয়ে সরকারেরই কোনো ধারণা নেই, আমি কী লিখব! ভয়ের চোটে বাবাকে কিছু বলতেও পারছি না। বসে বসে খাতায় কাটাকুটি খেলছি, হঠাৎ শুনি ড্রইংরুম থেকে বাবার উত্তেজিত কণ্ঠ ভেসে আসছে। দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি, বাবা রাজনৈতিক নেতাদের মতো মামাকে বকাঝকা করছেন। ব্যাপার তো কিছুই বুঝতে পারছি না। মামার ঘরে গিয়ে দেখি মামা মন খারাপ করে বসে আছেন। আমি বললাম,
মামা, বাবা হঠাৎ এত খেপে গেলেন কেন? যেকোনো সময় তো হার্টে অ্যাটাক হতে পারে।
আরে হার্টের অ্যাটাকের কথা ঝেড়ে ফেলে দে। একটু পর আমার ওপরই অ্যাটাক হতে পারে।
তুমি কী করেছ, মামা?
আর বলিস না, দুলাভাই সোয়াইন ফ্লুর জন্য মুখোশ আনতে বলেছিল। আমি এনেছি। মুখোশ দেখেই দুলাভাই···
মামা আমাকে একটা মুখোশ দেখাল। মুখোশ দেখে আমি তো হাসতে হাসতে আরেকটু হলে মাটিতে পড়ে যেতাম। কোনোমতে মামাকে বললাম, মামা, তুমি সোয়াইন ফ্লু ঠেকাতে এই মিকি মাউসের মুখোশ নিয়ে এসেছ! ভালোই হয়েছে, পাশের বাসার বাচ্চাটাকে দিলে ও এটা দিয়ে খেলতে পারবে।
মামা আমার দিকে কটমট করে তাকাতেই আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। বাবা এখনো চেঁচাচ্ছেন। আমি নিশ্চিন্ত হলাম। যাক, আজকে আর রচনা লিখতে হচ্ছে না।
আদনান মুকিত
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ৩১, ২০০৯
Leave a Reply