রাজার মন আর কিছুতেই ভালো যাচ্ছে না। রাজা দেখছেন, শুনছেন, খাচ্ছেন, কিন্তু তবু ঘণ্টায় ঘণ্টায় বুক কাঁপিয়ে হুহুংকারে একেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন। ‘না হে, মনটা ভালো নেই।’
রাজার মন ভালো করতে সেনাপতি আশপাশের গোটা দশেক রাজ্য জয় করে হেরো রাজাগুলোকে বন্দী করে নিয়ে এলেন। রাজা তাকিয়ে দেখলেন। তার পরই অজান্তে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন একটা। ‘মনটা বড় খারাপ রে।’
তখন মন্ত্রিমশাই রাজার তীর্থযাত্রা আর দেশভ্রমণের ব্যবস্থা করলেন। লোকলস্কর, পাইক-পেয়াদা নিয়ে রাজা শ দেড়েক তীর্থ আর দেশ-দেশান্তর ঘুরে এসে হাত-মুখ ধুয়ে সিংহাসনে বসেই বললেন, ‘হায় হায়! মনটা একদম ভালো নেই।’
ওদিকে ভাঁড়ামি করে করে রাজার বিদূষক হেদিয়ে পড়ায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। রাজনর্তকীর পায়ে বাত। সভাগায়কের গলা বসে গেছে। বাদ্যকরদের হাতে ব্যথা। রসুইকররা ছুটি চাইছে। রাজবৈদ্যকে ধরেছে ভীমরতি। সেনাপতি সন্ন্যাস নিয়েছেন। মন্ত্রিমশাইয়ের মাথায় একটু গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে বলে তাঁর স্ত্রী সন্দেহ করছেন। রাজ-পুরোহিত হোমযজ্ঞের এত ঘি পুড়িয়েছেন যে এখন ঘিয়ের গন্ধ নাকে গেলে তাঁর মূর্ছা হয়। সভাপণ্ডিতেরা রাজার মন খারাপের কারণ নিয়ে দিনরাত গবেষণা করছেন।
একদিন বিকেলে রাজা মুখখানা শুকনো করে রাজবাড়ির বিশাল ফুলবাগিচায় বসে আছেন। হঠাৎ সিংহ গর্জনে বলে উঠলেন, ‘গর্দান চাই!’ মন্ত্রী পাশেই ছিলেন, আপনমনে বিড়বিড় করছিলেন, মাথা খারাপের লক্ষণ। রাজার হুংকারে চমকে উঠে বললেন, ‘কার গর্দান, মহারাজ?’
রাজা লজ্জা পেয়ে বলেন, ‘দাঁড়াও, একটু ভেবে দেখি। হঠাৎ মনে হলো, কার যেন গর্দান নেওয়া দরকার।’
মন্ত্রী বললেন, ‘ভাবুন, মহারাজ, আর একটু কষে ভাবুন। মনে পড়লেই গর্দান এনে হাজির করব।’
বহুকালের মধ্যেও রাজা কিছুই মুখ ফুটে চাননি। হঠাৎ এই গর্দান চাওয়ায় মন্ত্রীর আশা হলো, এবার রাজার মনমতো একটা গর্দান দিলে বোধ হয় মন ভালো হবে। রাজ্যে গর্দান খুবই সহজলভ্য।
পরদিন সকালে রাজসভায় কাজ শেষ হওয়ার পর রাজা মন্ত্রীকে ডেকে বললেন, ‘না হে, গর্দান নয়। গর্দান চাই না। অন্য কী একটা যেন চেয়েছিলাম, এখন আর মনে পড়ছে না।’
সেই দিনই শেষ রাতে রাজা ঘুমের মধ্যে চেঁচিয়ে বললেন, ‘বিছুটি লাগা। শিগ্গির বিছুটি লাগা।’ মন্ত্রী রাজার কানে কানে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মহারাজ! কাকে বিছুটি লাগাতে হবে তার নামটা একবার বলুন।’
‘বিছুটি!’ বলে রাজা অবাক হয়ে গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগলেন।
পশ্চিমের পাহাড়ের গায়ে সূর্য ঢলে পড়ল। গরুর গাড়িবোঝাই বিছুটি এনে রাজবাড়ির সামনে জমা করা হয়েছে। রাজার সেদিকে মন নেই। রাজা রঙ্গঘরে বসে বয়স্যদের সঙ্গে ঘুঁটি সাজিয়ে দাবা খেলছেন। বয়স্যরা ভয়ে ভয়ে ভুল চাল দিয়ে রাজাকে জিতবার সুবিধে করে দিচ্ছেন। কিন্তু রাজা দিচ্ছেন আরও মারাত্মক ভুল চাল।
খেলতে খেলতে রাজা একবার গড়গড়ার নলে মৃদু একটা টান দিয়ে বললেন, ‘পুঁতে ফেললে কেমন হয়!’
মন্ত্রী কাছেই ছিলেন। বিড়বিড় করা থামিয়ে বিগলিত হয়ে বললেন, ‘খুব ভালো হয়, মহারাজ। শুধু হুকুম করুন।’
রাজা আকাশ থেকে পড়ে বললেন, ‘কিসের ভালো হয়? কিছুতেই ভালো হবে না, মন্ত্রী। মনটা একদম খারাপ।’
সেই রাতেই মন্ত্রী রাজ্যের সবচেয়ে সেরা বাছা বাছা চারজন গুপ্তচরকে ডেকে বললেন, ‘ওরে, তোরা চব্বিশ ঘণ্টা পালা করে রাজামশাইয়ের ওপর নজর রাখবি।’
পরদিনই এক গুপ্তচর এসে খবর দিল, ‘রাজামশাই রাতে অনেকক্ষণ হামা দিয়েছেন ঘরের মেঝেয়।’
আরেকজন বলল, ‘রাজামশাই একা একাই লাল জামা নেব, লাল জামা নেব বলে খুকখুক করে কাঁদছেন।’
আরেকজন এসে খবর দিল, ‘রাজামশাই এক দাসীর বাচ্চাছেলের হাত থেকে একটা মণ্ডা কেড়ে নিজেই খেয়ে ফেললেন এই মাত্র।’
মন্ত্রী বললেন, ‘ঠিক আছে, নজর রেখে যা।’
পরদিনই প্রথম গুপ্তচর এসে বলল, “আজ্ঞে, রাতে শোয়ার ঘরের জানালা দিয়ে যেই উঁকি দিয়েছি, দেখি রাজামশাই আমার দিকেই চেয়ে আছেন। দেখে বললেন, ‘নজর রাখছিস? রাখ।’ বলে চোখ বুজে শুয়ে পড়লেন।”
দ্বিতীয়জন বলল, “আজ্ঞে, আমি ছিলাম রাজার খাটের তলায়। মাঝরাতে রাজামশাই আমাকে বললেন, ‘কানে কেন্নো ঢুকবে, বেরিয়ে আয়’।”
তৃতীয়জন কান চুলকে বলল, “আজ্ঞে, আমি রাজার কুঞ্জবনে রাজার ভুঁইমালী সেজে গাছ ছাঁটছিলাম। রাজা ডেকে খুব আদরের গলায় বললেন, ‘ওরে, ভালো গুপ্তচর হতে গেলে সব কাজ শিখতে হয়। ওভাবে কেউ গাছ ছাঁটে নাকি? আয় তোকে শিখিয়ে দিই।’ বলে রাজা নিজেই গাছ ছেঁটে দেখিয়ে দিলেন।”
কিন্তু সবচেয়ে তুখোড় যে গুপ্তচর সেই রাখহরি তখনো এসে পৌঁছায়নি।
সকালবেলা রাজার শোয়ার ঘরের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল রাখহরি। রাজা বেরোতেই প্রণাম করে বলল, ‘মহারাজ, আমি গুপ্তচর রাখহরি আপনার ওপর নজর রাখছি।’
রাজা ্নিত হেসে হাই তুলে বললেন, ‘বেশ বেশ, মন দিয়ে কাজ করো।’
তারপর রাজা যেখানে যান পেছনে রাখহরি ফিঙের মতো লেগে থাকে।
দুপুর পর্যন্ত বেশ কাটল। দুপুরে খাওয়ার পর পান চিবোতে চিবোতে রাজা হঠাৎ বললেন, ‘চিমটি দে। রাম চিমটি দে।’
সঙ্গে সঙ্গে রাখহরি পেটে এক বিশাল চিমটি বসিয়ে দিল। রাজা আঁক করে উঠে বললেন, ‘করিস কী, করিস কী?’
রাখহরি বলল, ‘বললেন যে।’
পেটে হাত বোলাতে বোলাতে রাজা কিন্তু হাসলেন।
বিকেলে রাজা বাগানে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘ল্যাঙ মেরে ফেলে দে।’ বলতে না বলতেই রাখহরি ল্যাঙ মারল। রাজা চিতপটাং হয়ে পড়ে চোখ পিটপিট করতে লাগলেন! রাখহরি রাজার গায়ের ধুলোটুলো ঝেড়ে দাঁড় করিয়ে রাজার পায়ের ধুলো নিল। রাজা শ্বাস ফেলে বললেন, ‘হুঁ।’
রাত পর্যন্ত রাজা আর কোনো ঝামেলা করলেন না। রাখহরি রাজার সামনেই একটা আলমারির ধারে লুকিয়ে রইল। রাজা একটু হাসলেন। আপত্তি করলেন না। কিছুক্ষণ পরেই রাজা হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘ঠান্ডা জলে চান করব।’ রাখহরি বিদ্যুৎগতিতে রাজার ঘরের কলসের সবটুকু জল রাজার গায়ে ঢেলে দিল।
রাজা চমকে হেঁচে-কেশে উঠে বসলেন। কিন্তু খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন বলে মনে হলো না। রাখহরির দিকে চেয়ে একটু হেসে বললেন, ‘আচ্ছা, শুগে যা।’
রাখহরি না শুয়ে পাহারায় রইল।
সকালে উঠে রাজা হাই তুলে হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘দে, বুকে ছোরা বসিয়ে দে।’···চকিতে রাখহরি কোমরের ছোরাখানা খুলে রাজার বুকে ধরল।
ভ্যাবাচেকা খেয়ে রাজা বললেন, ‘থাক, থাক, তোর কথা আমার মনে ছিল না।’
রাখহরি ছোরাটা খাপে ভরতেই রাজা হোঃ হোঃ করে হাসতে লাগলেন। সে এমন হাসি যে রাজবাড়ির সব লোক ছুটে এল। রাজা হাসতে হাসতে দুহাতে পেট চেপে ধরে বললেন, ‘ওরে, আমার যে ভীষণ আনন্দ হচ্ছে! ভীষণ হাসি পাচ্ছে!’
খবর পেয়ে মন্ত্রীও এসেছেন। রাজার বুকে-পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘যাক বাবা! মন খারাপটা গেছে তাহলে।’
তার পর থেকে রাজার মন খারাপ কেটে গেলো। কিন্তু নতুন একটা সমস্যা দেখা গেল আবার। রাজা সব সময় কেবল ফিকফিক করে হেসে ফেলছেন। যুদ্ধে হার হয়েছে? ফিক-ফিক। অমুক মারা গেছে? ফিক-ফিক। রাজ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে? ফিক-ফিক।
রাজার হাসি বন্ধ করার জন্য মন্ত্রীকে এখন আবার দ্বিগুণ ভাবতে হচ্ছে।
[সংক্ষেপিত]
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ঃ ভারতীয় লেখক। ১৯৩৫ সালে তিনি বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেন।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ২৪, ২০০৯
Leave a Reply