নগর হিসেবে কিশোরগঞ্জ লন্ডন কি প্যারিস নয়, এ কথা শতবার মানি। তাই বলে আন্তনগর পদমর্যাদার ট্রেন এগারোসিন্দুর কিশোরগঞ্জ যাওয়ার পথে মেথিকান্দা স্টেশনে দাঁড়াবে, এত বড় অপমান মেনে নেওয়া কঠিন। অপমানের জ্বালা জুড়ানোর আগেই ধীরগতি ট্রেনের জানালা গলে আমার কপালে মিসাইলের আঘাত। ভাবলাম মরে গেছি। খানিক পরে কোনোমতে বেঁচে আছি নিশ্চিত হয়ে চোখ মেলতেই দেখি, স্টেশনে দাঁড়ানো রোগা-পটকা ছেলেটা দাঁত কেলিয়ে হাসছে। পাশে দাঁড়ানো আরও চিকন ঝিটকে শয়তান সমবয়সীকে হেসে হেসে আঙুল তুলে বলছে, ‘পাথরটা ওই বেডির কপালে লাগছে।’ এ যেন অ্যাপাচির পাইলটের মুখে সাফল্যের হাসি, যদি গোলাটা তোরাবোরা গুহায় লাদেনের গায়ে লাগত! শতভাগ সাফল্যের দাবিদার ছোকরাকে দু-চার ঘা লাগিয়ে আসব কি না এমন ভাবাভাবির মধ্যে ছেলেটি তার বাপের হাত ধরে আমার কম্পার্টমেন্টে আমার সামনে হাজির। কপালের ব্যথায় কাতর আমি তেড়ে ওর বাপটাকে বললাম, ‘আপনি কি জানেন, আপনার ছেলে কত বড় বদমাশ?’
‘আরে সব্বনাশ! বদমাশ মানে, মহা বদমাশ! স্বভাবে-খাসলতে অক্করে মামুর গুষ্টি। আচ্ছা যাউক গা! আপনে এই খবর জানলেন কীভাবে?’
‘আপনার ছেলে ট্রেনে ওঠার আগে আমার কপালে পাথর ছুড়ে মেরেছে।’
‘আরে বেআক্কেলের ঘরের বেআক্কেল। পাত্থর মারবি ট্রেন ইস্টিশন ছাইরা চইলা যাওনের কালে-ট্রেন আওনের কালে পাত্থর মাইরা কেউ ধরা খায়?’
নির্বোধ ছেলের ঘাড়ে বেগে ধাক্কা দিয়ে রাগে গজগজ বাপ অন্য কামরায় মিলিয়ে যেতে কলমভর্তি ট্রে গলায় ঝুলিয়ে কামরায় আরেক কিশোরের প্রবেশ। কিশোরের বয়ান থেকে বোঝা গেল, বারবার শিষ বদলে ওর কলম শতবর্ষী। ১০০ বছর ব্যবহারেও ওর কলম যে ভাঙবে না, মচকাবে না, এই তথ্য প্রমাণ করতে গিয়ে ছেলেটি ট্রেনের বাংকারের গায়ে মধ্যম মাপে কলমের এক ঘা মারতেই হাতের কলম ভেঙে দুইখান। কামরা ভর্তি লোকজনের হাসির হুল্লোড় থেকে ছেলেটিকে বাঁচানোর জন্য আমার পাশে বসা জ্ঞানী চেহারার মানুষটা গম্ভীর গলায় বলেন, ‘শোনো হে বালক, মসি অসি অপেক্ষা শক্তিশালী এ কথা সত্য; কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে···।’ লোকটার মুখের বাণী না ফুরাতে রক্তচক্ষু কিশোর ঢিটমোরগের মতো রোয়া ফুলিয়ে এগিয়ে আসে। বলে, ‘ওসির ভয় দেখান কারে? পুলিশরে আমি ডরাই? কলম কি আপনার মাথায় বাড়ি দিয়া ভাঙছি? ভাঙা কলম দিয়া আপনের চোক্ষে গুল্লা দিছি? তাইলে আপনে আমারে ওসির ভয় দেখান, বিষয়ডা কী?’ বিষয়টি অমীসাংসিত রেখে ছেলেটিকে কামরা ছেড়ে নেমে যেতে হলো, কারণ ট্রেন তখন চলতে শুরু করেছে। সহযাত্রীর জ্ঞানের বাণী বিফলে যাওয়ার ব্যথা মুছে দেওয়ার জন্য আগ বাড়িয়ে বলি, ‘আপনার জ্ঞানের কথা অতি ওজনদার; কিন্তু শব্দ নির্বাচনে ভুল হয়ে গেছে। ছেলেটি অসি না চিনলেও ওসি চেনে। আর যেটুকু চেনে তাতে ওর ক্ষিপ্ত হওয়ার···।’
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে জ্ঞানী মানুষটা আমার ওপর অঝোরে জ্ঞানবর্ষণ শুরু করেন। তাঁর তাবৎ বাণীর সারকথা, দেশটা মূর্খ-অর্বাচীন আর চোরচোট্টায় ভরে গেছে। নীতিমান জ্ঞানী মানুষটি এখন এই দুই গ্রুপ লোকের জ্বালায় ভীষণ বিরক্ত। নীতিমান মানুষটির জ্ঞানের বাণী শুনতে শুনতে পথ ফুরিয়ে যায়। ট্রেন এসে কিশোরগঞ্জ স্টেশনে ভেড়ে। স্টেশনে নামব বলে ট্রেনের মাথার দিকে হাতটা দিতেই জ্ঞানী সহযাত্রী ধমকের সুরে বলেন, ‘ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন? স্টেশনের গেটে দাঁড়ানো চোরগুলো টিকিট দেখতে চাইবে। না দেখাতে পারলে ফের ২০ টাকা ঘুষ দিতে হবে।’
‘এই তো আমার টিকিট আমার হাতে। আপনার টিকিট কি হারিয়ে গেছে?’
‘ট্রেন জার্নির সময় আমি নৈতিক দায়িত্ব থেকে টিকিট কিনি না। রেলওয়ের পিয়ন থেকে বড়সাহেব, সব ব্যাটা চুর। ২০০ টাকা খরচ করে টিকিট কিনলে সে টাকা ভাগবাটোয়ারা হয়ে ১০টা চুরের পকেটে যাবে। তার চেয়ে বিনা টিকিটে ট্রেনে উঠে ২০ টাকা চেকারের হাতে গুঁজে দিলে একজন চুরের পেট ভরল। ট্রেন স্টেশনে পৌঁছালে পেছনের কম্পার্টমেন্ট দিয়ে নেমে কাঠগুদামের পেছন দিয়ে বাউলি কেটে শহরে ঢুকে যাবেন। এ দেশে টাকা দিয়ে টিকিট কেনা রীতিমতো অনৈতিক।
অহিফেন সেবনে বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের জ্ঞানচক্ষু খুলে গিয়েছিল-বিনা আফিমেই আজ আমার জ্ঞানচক্ষু বিস্কারিত। ভাবলাম, টিকিট কেনার আগে কেন এই অতি সূক্ষ্মবুদ্ধি-নীতিমান মহাপুরুষের দেখা পেলাম না।
তুষার কণা খোন্দকার
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ২৪, ২০০৯
Leave a Reply