আমার চাচার বাসা থেকে স্টেশন যেতে হাঁটাপথে আট মিনিট লাগে। চাচা সর্বদাই বলেন, ‘দেখ, হাতে ১৫ মিনিট সময় নিয়ে আস্তেসুস্থে যেতে হয়।’
তিনি অবশ্য সর্বদাই যা করে থাকেন তা হলো, পাঁচ মিনিট আগে তৈরি হয়ে দৌড় লাগান।
চাচা ঘুম থেকে ওঠেন সেই ফুটি সকালে। কখনো এর অন্যথা হয় না। কিন্তু হলে হবে কী, ঠিক শেষ মুহূর্তে যত রাজ্যের ঝঞ্ঝাট দেখা দেবেই। প্রাতরাশ শেষ হওয়ার পর তাঁর কাজ হবে খবরের কাগজটা হারিয়ে ফেলা। কোনো জিনিস হারালে চাচা কখনো বলেন না, ‘আমি কী ভুলো লোক, দেখ! সব জিনিস আমি কেমন হারিয়ে ফেলি, কোথায় যে কোন জিনিসটা রাখি তা আমার মনেই থাকে না। বুড়ো হয়েছি তো, আর সেটাকে খুঁজে পাই না। আমার জন্য আর পাঁচজনের কী ভোগান্তি।’
আসলে কোনো কিছু হারালেই তিনি নিজেকে ছাড়া আর সবাইকেই দায়ী করবেন। চেঁচিয়ে উঠে বলবেন, ‘এক মিনিট আগেই তো ওটা আমার হাতে ছিল।’
চাচি হয়তো বললেন, ‘ওটা বোধ হয় তুমি বাগানে ফেলে এসেছ।’
‘বাগানে ফেলে আসতে যাব কেন? বাগানে আমার কাগজের কী দরকার? কাগজটার প্রয়োজন ট্রেনে।’
‘তোমার পকেটে পোরোনি তো?’
‘তোমার ধারণা কি এই নটা বাজতে মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি, আর আমি এটা খুঁজে মরছি নিজের পকেটে পুরে? আমাকে বোকা ঠাউরেছ নাকি?’
একজন হয়তো এ সময় বলল, ‘এটা কী?’ -ভাঁজ করা একটা কাগজ তাঁর সামনে তুলে ধরে।
রেগেমেগে তিনি বলে উঠবেন, ‘আমি চাই আমার জিনিসপত্র যেমন আছে তেমনি যেন থাকে। কেউ তা ঘাঁটাঘাঁটি করুক তা আমার একদম পছন্দ নয়।’
তারপর ব্যাগ খুলে সেটিকে ভরতে গিয়ে একবার নজর বুলিয়েই দম মেরে চুপ হয়ে রইলেন।
‘কী হলো?’ চাচি হয়তো জিজ্ঞেস করলেন।
কাগজটা টেবিলের ওপর সজোরে আছড়ে চাচা হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘এটা তো কালকের কাগজ।’
শেষ পর্যন্ত অবশ্য আসল কাগজটা পাওয়া গেল। দেখা গেল, সেটার ওপরই তিনি বসে আছেন।
করুণ হাসি হেসে চাচার উক্তি, ‘তোমাদের চোখের সামনেই রয়েছে, অথচ···।’ ভাবটা এই যে যত সব নিরেট নির্বোধদের সঙ্গে তাঁকে থাকতে হয়।
তারপর চাচা ছুটবেন হলঘরে। চাচির নৈমিত্তিক কাজ হচ্ছে সেখানে চাচাকে বিদায় জানাতে বাচ্চাকাচ্চাদের জড়ো করা।
ওদের একজনকে যথাসময়ে পাওয়া যাবে না এবং শুরু হয়ে যাবে তাকে হাজির করার জন্য চিৎকার-চেঁচামেচি। কয়েক মিনিট এভাবেই কেটে যাবে এবং ইতিমধ্যে চাচা তাঁর ছাতা আর চশমা খুঁজে পাবেন না। যখন হলঘরে সবাই হাজির হলো, তখন দেখা গেল, ঘড়িতে টং টং করে নটা বাজছে। বড় ছেলেটা বলে উঠল, ‘ঘড়িটা পাঁচ মিনিট ্লো যাচ্ছে! কাল আমার স্কুলে যেতে দেরি হয়েছিল, তাই বলছি।’
এই শুনে চাচা হন্তদন্ত হয়ে গেটের দিকে দৌড় শুরু করবেন এবং যেতে যেতে টের পাবেন যে ছাতা আর ব্যাগ দুই-ই ফেলে এসেছেন। শেষমেশ তিনি যখন নিষ্ত্র্নান্ত হলেন, তখন দেখা গেল যে হলঘরের টেবিলে তাঁর সবচেয়ে দরকারি জিনিসটাই পড়ে আছে। বাড়ি ফিরে এসে তিনি কী কাণ্ডটাই না বাধাবেন, সবারই এই এক ভাবনা।
অনুবাদঃ অমলকৃষ্ণ গুপ্ত
জেরোম কে জেরোমঃ ইংরেজি রসসাহিত্যে এক অতি উল্লেখযোগ্য লেখক। তাঁর বিখ্যাত রম্যরচনা দি আইডল থটস অব অ্যান আইডল ফেলো ২৫টি সংস্করণেরও বেশি বিক্রি হয়েছে। বইটি তিনি উৎসর্গ করেন তাঁর অতিপ্রিয় বন্ধু ধূমপানের ‘পাইপ’কে এবং সে জন্য বিশেষণ ব্যবহার করেছেন পুরো এক পাতা। ওপরের গল্পটি তাঁরই একটি উপভোগ্য ছোট্ট নকশা।
জেরোম কে জেরোম
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ০৩, ২০০৯
Leave a Reply