গত ষাট বছরেও নাকি এত বৃষ্টি হয়নি। রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে ঢাকাসহ কয়েকটি শহরে, ৩৩৩ মিলিমিটার। সন্ত্রাস, জ্যাম, দুর্নীতি, লোডশেডিং, জনসংখ্যা-এসবে ঢাকা আগেই ডুবে ছিল, এবার ডুবল ফ্রেশ বৃষ্টির পানিতে। এতই ডোবা ডুবল যে পরদিন আমার মোবাইল ফোনে নানা রকম এসএমএসে এসওএস আসতে শুরু করল। কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যাকঃ
আমার বাসায় হাঁটুপানি, আপনাদের কী অবস্থা?
তাকে জানাই, আমরা ভালোই আছি, পানি ওঠেনি। সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা এসএমএসঃ
আমাদের এখানে কোমরপানি, আপনাদের কী অবস্থা?
তাকেও জানাই, আমরা ভালোই আছি, পানি ওঠেনি। সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা এসএমএসঃ
আমাদের এখানে গলাপানি, আপনাদের কী অবস্থা?
তাকেও জানাই, আমরা ভালোই আছি, পানি ওঠেনি। সঙ্গে সঙ্গে ফের আরও একটা এসএমএস এসে হাজির!
আমাদের বাসায় হাঁটুপানি, আপনাদের কী অবস্থা?
এবার আমি চিন্তিত হই। প্রথম এসএমএসে যখন বলেছিল হাঁটুপানি, তখন অত চিন্তিত হইনি। কিন্তু এবার কেন চিন্তিত হলাম? আসলে শেষ এসএমএসে যে লিখেছে তার ঘরে হাঁটুপানি, সে থাকে চতুর্থ তলার এক ফ্ল্যাটে, বনানীতে। তবে কি বনানীতে আলাদাভাবে ৩৩৩ মিটার বৃষ্টি হলো? না, তা নয়, ব্যাপারটা একটু পরে ক্লিয়ার হলাম। তাদের নতুন ফ্ল্যাটের ছাদের সব পানি কীভাবে যেন বাইপাস হয়ে নিজেদের ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে! সেই কারণে চতুর্থ তলার ফ্ল্যাটে ঘরে ঘরে হাঁটুপানিতে থই থই!!
আরেকজন ফোন করে হাহাকার করে উঠল, তার নতুন কেনা গাড়ি সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে বৃষ্টির পানিতে···এ গাড়ি কি ঠিক হবে? আমি গাড়ির পত্রিকার সম্পাদক (অটোলাইন) হিসেবে আশ্বাস দিই, ‘অবশ্যই হবে।’ পরদিনই অবশ্য তার খুশি খুশি গলায় ফোন পাই। আমি ভাবলাম, বোধ হয় পানি সরে গেছে, গাড়িও স্টার্ট নিয়েছে। তা না, সে জানাল, পানি অনেকখানি সরে গেলেও গাড়ির চার চাকা এখনো পানির তলে খাবি খাচ্ছে। তবে গাড়ির ভেতর মাছ ভর্তি! পাশেই একটা পুকুর ছিল বলে সব মাছ বেরিয়ে গিয়েছিল আগেই। তারই একাংশ তার গাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল হয়তো। ফলে গাড়ির মালিকের পোয়াবারো, আগামী কয়েক দিন বাজার না করলেও চলবে!
রস+আলোর পাঠকদের ভাবার কারণ নেই যে নিজের ঘরে পানি ঢোকেনি দেখে এই জলাবদ্ধতা নিয়ে আমি তাদের সঙ্গে রস করতে বসেছি। পানির বিপদ আমি বুঝি। ১৯৮৮ সালের বন্যায় আমার একতলা ভাড়া বাসা পুরোটাই ডুবে গিয়েছিল রাতারাতি! আমি হতভম্ব হওয়ার সময়টুকু পর্যন্ত পাইনি। তখন থাকতাম কল্যাণপুরে, এক ভাড়া বাসায়। হঠাৎ হু হু করে পানি বাড়ছিল রাতের বেলা। এর মধ্যেই পুরো এলাকায় কারেন্ট অফ করে দেওয়া হলো। বাসায় ছিল বড় ভাইয়ের তিন মেয়ে ও বোনের মেয়ে। তারা তখন ছোট ছোট। আমার বাসায় বেড়াতে এসেছে। আমি ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম! রাতটা কোনোমতে জেগে থেকে কাটিয়ে ভোরে প্রায় গলাপানি ভেঙে কীভাবে যে ওদের নিয়ে বের হয়ে এসেছিলাম, তা নিচে আমি জানি, আর ওপরে জানে বন্যা দেনেঅলা!
এবারের বৃষ্টির জলাবদ্ধতাও কিন্তু ঠিক সে রকম ঘটনাই ঘটিয়েছে। পার্থক্য শুধু বন্যার পানি আর বৃষ্টির পানিতে।
সাধারণ মানুষের বিপদ হয়েছে সীমাহীন। এর মধ্যেও তারা হাস্য-কৌতুক করে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করছে। একজনকে দেখলাম, মোবাইল ফোনে চিৎকার করে বলছে, ‘আমার বাড়িঘর তো সব ডোবছে···বউ-বাচ্চা লয়া কী করি, কই যাই···তোর ওইখানে কি আমু?’ যার ওইখানে সে যেতে চেয়েছে, সে হয়তো ‘না’ বোধক কিছু বলেছে। তখন সে উচ্চ স্বরে বলল, ‘তাইলে আরকি, ওভারব্রিজে উইট্টা ডিজিটাল বাংলাদেশ দেহি বয়া বয়া!’ তার কথায় আশপাশের লোকজন হেসে উঠল।
ঢাকার এই ভয়াবহ জলাবদ্ধতার কারণ খুঁজতে গিয়ে টিভির সাংবাদিকেরা ওয়াসা আর সিটি করপোরেশনে ছোটাছুটি করেছেন। কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁরা অবশ্য একে অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে দাগানোর চেষ্টা করেছেন বলে মনে হলো। তবে বৃষ্টির পানিতে গুলি ড্যাম বলে বোধ হয় কোনোটাই সেভাবে ফুটল না। তবে এ রকম জলাবদ্ধতা চলতে থাকলে ওই দুই প্রতিষ্ঠানকেও একদিন পানির নিচে যেতে হবে। কাজেই তাদের গা-ঝাড়া দেওয়া দরকার!
শেষে একটা গল্প বলি, গল্পটা আমাদের নয়, অন্য দেশের। অন্য একটা দেশ একদম আমাদের মতো। এ রকম হঠাৎ বৃষ্টিতে তাদেরও রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, অফিস-আদালত সব ডুবে গেল। এমনকি তাদের দেশের প্রেসিডেন্টের বাসার সামনেও গলাপানি। প্রেসিডেন্ট এর মধ্যেই রওনা হয়েছেন তাঁর কার্যালয়ে। তাঁর গাড়িবহর যখন জমাট পানিতে ঢেউ তুলে ছুটছে, তখন সাঁতার না-জানা এক সাধারণ লোক পানিতে প্রায় তলিয়ে গেল। সে হয়তো হঠাৎ পানির ধাক্কা সামলাতে পারেনি। সে চেঁচিয়ে উঠলঃ
‘মি· প্রেসিডেন্ট, আমাকে বাঁচান,
আমি ডুবে যাচ্ছি···আমি সাঁতার
জানি না!’ প্রেসিডেন্ট তার কথা শুনলেন, তবে বেশ বিরক্ত হলেন
বলে মনে হলো। মনে মনে বললেন, ‘আরে, অনেকেই অনেক কিছু জানে না। আমিও যেমন দেশ চালাতে
জানি না, তাই বলে সেটা চেঁচিয়ে সবাইকে জানাতে হবে?···গাধা কোথাকার!!
আহসান হাবীব
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ০৩
Leave a Reply