গ্রামের এক বড়সড় বাজার। মানুষজনের আগমন, বেচাকেনার ধুমধাম আর পকেটমার, চাপাবাজ, টাউটবাটপারের আনাগোনাও কম নয়। সেই বাজারের এক কোনায় একটু নিরিবিলিতে দু-তিনটি হোটেল। সেই হোটেলগুলোর একটার ভেতরে বসে হোটেলের মালিক ও তার এক বন্ধু গল্পগুজবে ব্যস্ত ছিল। তখন একটা লোক বড় একখানা ধামা হাতে করে হোটেলের সামনের রাস্তায় দাঁড়াল। তার থুঁতনিতে ছাগলা দাড়ি, মুখে বসন্তের দাগ, চোখ কোটরাগত, মাথাভর্তি টাক। দেখতে অনেকটা আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া পেশাদার সাক্ষীর মতো। লোকটি ইতিউতি তাকাচ্ছিল। বোঝা যাচ্ছিল, সে কাউকে খুঁজছে। হোটেলমালিকের বন্ধু বলল, লোকটা চোরের মতো এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে, মতলব সুবিধার না। হোটেলের মালিক বলে, ‘না, কারও জন্য অপেক্ষা করছে। তাই আগন্তুকের দৃষ্টি পথের দিকে, বারবার উদ্গ্রীব হয়ে তাকাচ্ছে।’ হোটেলমালিকের বন্ধু বলে, ‘যেভাবে তাকাতাকি করছে, তাতে একে একটু প্যাঁচে ফেলা যায় না? একটু রগড় তো হবে!’
হোটেলওয়ালা বলল, ‘চেহারা দেখে মনে হয়, সহজ মাল না। তবে যেভাবে ব্যাক্কলের মতো হাবভাব করছে তাতে ভালোমতো বিপদে ফেলা যায়। তবে তা না করে রগড়ের ঢংয়ে একটু চিকনে মাইর দিয়া কিছু আদায় করা যায়।’
বন্ধু বলল, ‘চাঁদাবাজির যুগে বুদ্ধিটা মন্দ না।’ হোটেলওয়ালা বন্ধুকে নিয়ে বাইরে এল। বাইরে আসার আগে বাবুর্চিকে ডেকে গোশতে খুশবুদার মসলা দিয়ে বাগাড় দিতে বলল। ফলে অল্প সময়েই রান্না করা গোশতের গন্ধে চারদিক ম-ম করতে থাকল।
হোটেলমালিক ছাগলদাড়ি টাকমাথার কাছে গিয়ে বলে, ‘ওই মিয়া, খিদা লাগছে? হোটেলের ভিতরে আইসা অর্ডার দেন, যা খুশি খান। তারপর বিল মিটাইয়া চইল্যা যান। তা না কইরা রাস্তায় খাড়াইয়া অর্ধেক খাওন খাইতেছেন। এইডা কী কারবার!’
লোকটি বলল, ‘অর্ধেক খাওন খাইতেছি মানে? আমি একজন মানুষের জন্য খাড়াইয়া আছি।’
হোটেলমালিক বলল, ‘মিয়া, ফাঁকতালে অর্ধেক ভূরিভোজনের তালে আছেন তা বুঝি না মনে করছেন? জানেন না, ঘ্রাণ শুকলে অর্ধভোজন হয়ে যায়! দাম ফালান।’ লোকটা হঠাৎ অন্য রকম হয়ে যায়। দৃষ্টি কঠোর, চোয়াল শক্ত এবং চেহারায় প্রচণ্ড আস্থা। ফিচকে হাসি হেসে বলে, ‘ও, ঘ্রাণে অর্ধভোজনের সেই গপ্প? রান্নায় জিহ্বায় পানি আনা গন্ধ তো ঠিকই পাচ্ছি। নাক সুখ পাচ্ছে, কিন্তু উদর তো চোঁ চোঁ করেও পাচ্ছে না কিছু!’ এই বলে সে কুঁচকানো পাঞ্জাবির পকেট থেকে আট আনা পয়সা বের করে হোটেলওয়ালার কানের কাছে কয়েকবার টং টং করে বাজিয়ে বলল, ‘আমার নাকের সুখানুভূতিতে অর্ধেক ভোজন যদি হয়ে থাকে, তাহলে পয়সার টং টং শব্দ কানে শুনে তোমারও অর্ধেক দাম পাওয়া হয়ে গেছে। ইবার ফুট। গিরিঙ্গি কইরো মানুষ চিনা!’
শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত গ্রামবাংলার রঙ্গ রসের গল্প থেকে সংগৃহীত
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ২৭, ২০০৯
Leave a Reply