প্রচণ্ড গরমে ঘেমে বাস থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলাম। মনে হচ্ছে কেউ একজন আমাকে জোর করে ওভেনে ভরে মুরগি গ্রিল করার মতো করে গ্রিল করছে। এই গরমে হেঁটে বাসায় যাওয়া অসম্ভব। সুন্দর একটা ফাস্টফুডের দোকানে ঢুকে পড়তে হবে। কিছুক্ষণ এসির বাতাসে রেস্ট নিয়ে রোদটা কমলে তারপর হাঁটা শুরু করব। রাস্তার পাশেই অনেক ফাস্টফুডের দোকান। সবগুলোতেই এসি আছে। হাতের ডান পাশের দোকানটায় ঢুকে পড়লাম। আহ! কী শান্তি! এই দোকানে যারা কাজ করে, তাদের মতো সুখী আর কে আছে? কী ঠান্ডা! কোনার দিকের একটা টেবিলে বসতে গিয়ে চমকে উঠলাম আমি। একেবারে পেছনের টেবিলে ওটা কে? নাজমুল না? হ্যাঁ, তাই তো। সঙ্গে আবার একটা মেয়েও আছে দেখছি। শালা, তোকে কত খুঁজেছি। সব বেকার খোঁজে চাকরি আর আমি খুঁজেছি তোকে। আমার ১১ হাজার ১৬৪ টাকা মেরে দিয়ে এখানে বসে আরামে জুস খাচ্ছিস! আজ কে তোকে আশা দেবে? টাকা আমি আদায় করবই। দ্রুত নাজমুলের সামনে গিয়ে বললাম, ‘আরে দোস্ত, তুই?’ নাজমুল থতমত খেয়ে বলল, ‘কবির, কেমন আছিস? কত দিন পর দেখা। জলি, ও আমার ছোটবেলার বন্ধু কবির। দাঁড়িয়ে আছিস কেন, বস।’ আমি বসলাম। মেয়েটার নাম তাহলে জলি। কোনো ভূমিকায় না গিয়ে সরাসরি টাকার কথাটা তুললাম আমি, ‘নাজমুল, তুই মনে হয় আমার ১১···।’ পায়ে একটা লাথি খেয়ে চুপ করে গেলাম। নাজমুল বলল, ‘আরে ভুলিনি। তুই অঙ্কে ১১ পেয়েছিলি। তারপর স্যার তোকে ১১টা বেতের বাড়ি মেরেছিল, সব মনে আছে। এত দিন পর দেখা, একটু ভালো খাওয়াদাওয়া না হলে কি হয়? চল, অর্ডারটা দিয়ে আসি।’ ব্যাটার মতলবটা কী ঠিক বুঝতে পারছি না। বলেই ফেললাম, ‘নাজমুল! তুই টাকা দিবি কি না বল। বহুদিন ঘুরিয়েছিস, সিম বদলিয়েছিস। ভেজাল করলে তোর সব প্রেমের ইতিহাস ওই জলির কাছে বলে দেব।’ একেবারে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল নাজমুল। বলল, ‘দোস্ত, তোর পায়ে ধরি, ওর সঙ্গে আমার বিয়ে পাকা হয়ে আছে, পাগড়ি-শেরওয়ানিও কিনে ফেলেছি। প্লিজ, তুই এসব কিছু বলিস না। পারলে আমার সম্পর্কে ভালো কিছু বলিস। আমি এখান থেকে বেরিয়েই তোর টাকা দিয়ে দেব। এই তো পাশেই এটিএম বুথ।’ এবার একটু শান্তি পেলাম। সোজা কথায় কোনো কাজ হয় না। টেবিলে ফিরে এসে ভাবছি, ওর সম্পর্কে ভালো কী বলব? ওর কোনো কিছুই তো ভালো না। ওয়েটার এসে খাবার দিয়ে গেল। খেতে খেতে বললাম, ‘বুঝলেন ভাবি, নাজমুল ছিল তুখোড় ছাত্র। একবার হায়ার ম্যাথে ১০০-তে ৯৫ পেয়েছিল! তাই নারে?’ নাজমুলের মুখে কোনো কথা নেই। জলি বলল, ‘কী যে বলেন ভাই, ওর তো হায়ার ম্যাথই ছিল না, আপনি হয়তো ভুল করছেন।’ ‘ও তাই তো, অনেক দিন আগের কথা, হতে পারে, হতে পারে। তবে ও ভালো ক্রিকেট খেলত। ছয় মেরে একবার জালাল স্যারের চশমা ভেঙে ফেলেছিল।’ জলি খুব অবাক হয়ে বলল, ‘কই, খেলার কথা তো আমাকে বলোনি। তুমি তো বলেছ খেলাধুলাই করতে না। মিথ্যে বলেছ কেন?’ নাজমুল আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল, ‘ওই দু-এক দিন খেলেছি, তেমন কিছু না। ইয়ে···তোরা বস, আমি একটু এটিএম বুথ থেকে আসছি।’ এটিএম বুথে যাচ্ছে! তার মানে আজ টাকাটা পাব! ১১ হাজার ১৬৪ টাকা দিয়ে কী করব তাই ভাবছিলাম, হঠাৎ জলি বলল, ‘আপনারা খুব পুরোনো বন্ধু, তাই না?’ ‘হ্যাঁ, একদম ওয়ান থেকে কলেজ পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে ছিলাম। এমনকি স্কুল থেকে আমাদের টিসিও দিয়েছিল একসঙ্গে।’ জলি খুশি খুশি কণ্ঠে বলল, ‘ওমা, তাই নাকি? কী সুইট!’ আমার উঠল রাগ। দুজনকে একসঙ্গে টিসি দিয়েছে এর মধ্যে সুইটের কী আছে? নাহ! দেশের অবস্থা খুব খারাপ। জলি ফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। কথা শেষে বলল, ‘কবির ভাই, আপনি বসেন, আমি একটু ওয়াশরুমে যাচ্ছি।’ ‘যান, কোনো সমস্যা নেই।’ আবার টাকার কথা ভাবতে লাগলাম আমি। একটা মুরগি সদকা দেব নাকি? এত দিন পর টাকাটা পাব! দোকানের বাকিটাও শোধ করতে হবে··· শালা নাজমুল, এত দিন পালিয়ে থেকেও শেষ রক্ষা হলো না। এমনি হয়, ভালো মানুষের টাকা নিয়ে বেশি দিন বিটলামি করা যায় না। কিন্তু ব্যাটা এখনো আসছে না কেন? এটিএম বুথটা
তো পাশেই। জলিও তো আসছে না। কী যে করি! ওয়েটার ৭১৮ টাকার বিল দিয়ে গেছে। মানে কী? এই টাকা কে দেবে? ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, অন্য এক মহিলা বেরিয়ে এল। ঘটনা বুঝতে আর বাকি রইল না। দরজা খুলে বেরোতে যাব, ওয়েটার বলল, ‘স্যার, বিলটা···।’ মানিব্যাগে ৭২০ টাকা ছিল, দুই টাকা রেখে পুরোটা দিয়ে এটিএম বুথের কাছে এলাম। বুথের গার্ড ছাড়া কোথাও কেউ নেই। হায় হায় রে! টাকার আশায় ওর বাসার ঠিকানা, নম্বর কিছুই নেওয়া হয়নি। আমি ফুটপাতেই বসে পড়লাম। নাজমুল রে, তুই এটা কী করলি! আবার পালালি!
আদনান মুকিত
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ২৭, ২০০৯
Leave a Reply