আষাঢ় মাসের রাত। বৃষ্টি হচ্ছে ঝুম। গল্পের বই পড়তে পড়তে কখন যে বাতি না নিভিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি। মাথার কাছে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শে ঘুম ছুটে গেল। চোখ খুলেই টের পেলাম, একটা ধাতব কিছু আমার পাশে দাঁড়িয়ে-ওই প্রাণীটা।
‘যাও, বাথরুম থেকে হাত-মুখ ধুয়ে আসো। তোমার সাথে আমার কথা আছে।’ ধাতব কণ্ঠে আদেশ দিল সে।
গর্দভটা বলে কী? কোথায় সে এই অসময়ে আমার ঘুম ভাঙানোর জন্য মাফ চাইবে, তা না করে বলে কিনা হাত-মুখ ধুয়ে আসতে।
এর আগেও সে কয়েকবার এসেছিল। তার একটাই চাওয়া, তাকে পৃথিবীর সাহিত্য-জগৎ সম্পর্কে কিছু ধারণা দেওয়া।
আমি তোয়ালে দিয়ে হাত-মুখ মুছতে মুছতে খাটে গিয়ে বসলাম। ভিনগ্রহের প্রাণীটা আমার চেয়ারে বসে আছে।
তারপর বলো, কী খবর তোমার? গত কয় মাস কেমন দেখলে পৃথিবী?
ভালোই। তোমরা প্রযুক্তিতে এখনো পিছিয়ে থাকলেও সাহিত্যে অনেক এগিয়ে গেছ।
আমাদের সাহিত্য নিয়ে ব্যাটার ছোট মুখে বড় কথা একদমই মানাচ্ছে না। আমার মেজাজটা আবার খারাপ হয়ে গেল। পারলে তার চুলহীন টাক মাথায় দুটো চাঁটি মারি।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে সরাসরি এই অসময়ে আমার আরামের আষাঢ়ে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানোর কারণটা জেনে তাড়াতাড়ি তাকে বিদেয় করতে পারলেই বাঁচি। হ্যাঁ, বলো তোমার সিরিয়াস কথাটা কী?
‘তোমাদের সাহিত্য নিয়ে আমার টিম গত কয় মাস বেশ স্টাডি করেছে। কিন্তু তোমাদের সাহিত্যের অনেক কিছুই আমরা নিতে পারছি না। বিশেষ করে ইলজিক্যাল বিষয়গুলো। আমরা তোমাদের মতো ইমোশনাল কিংবা অ্যান্টিলজিক্যাল না। তোমাদের ঈশপের গল্পগুলো সেদিক থেকে বেশ লজিক্যাল।’
তাহলে তোমাদের দিয়ে সাহিত্য হবে কী করে? সাহিত্যে তো ইমোশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা এলিমেন্ট, যেটা তোমাদের নেই বলেই আমি নিশ্চিত।
কিন্তু আমি আরও একটা ধারা পেয়েছি, যেটা নিয়ে আমরা বোধহয় কাজ করতে পারব?
আমি খুব অবাক হলাম। এই জাতের ইমোশনলেস একটা প্রাণী আমাদের পৃথিবীতে কী এমন খুঁজে পেতে পারে? আমি অবাক ভাবটা না দেখিয়ে খুবই নির্লিপ্তভাবে জিজ্ঞেস করলাম, কী সেটা?
আষাঢ়ে গল্প।
আষাঢ়ে গল্প! আমি প্রায় চিৎকার করে উঠলাম। এ কী বলে সে! আষাঢ়ে গল্প নিয়ে ওরা কী করবে? তোমাদের গ্রহে কী বৃষ্টি হয়? আষাঢ় মাস আছে? আমি মোটামুটি প্রায় খেপে উঠলাম।
তুমি লজিকহীনভাবে রেগে উঠছ। শোনো, তোমাদের দেশের বিজ্ঞাপনগুলোর মধ্যে আমি আষাঢ়ে গল্পের ভাবটা বেশ পেয়েছি। আমাদের বিজ্ঞাপনে তুমি আষাঢ়ে গল্পের কী দেখতে পেলে?
আমি টিভিতে দেখেছি মডেলরা সেজেগুজে বিভিন্ন প্রসাধনের গুণগান গায়। কিন্তু আমি ওই সব বিজ্ঞাপনের শুটিং দেখেছি। ওদের হাজার হাজার টাকা খরচ করে পারলার থেকে মেকআপ করিয়ে এনে ১০-২০ টাকার পণ্যের গুণগান করতে বলা হয়। ওরা তা-ই করে।
আমি মনে মনে গাধাটার একটু প্রশংসা করতে বাধ্য হলাম। তো, এখন তুমি আমার কাছে কেন এসেছ?
তোমার সঙ্গে আমার যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করতে আসা, সেটা আমি করে ফেলেছি।
আমার মনেই ছিল না এই গাধাটা আবার ওদের গ্রহের স্পেশাল এজেন্ট। থট রিডিং-জাতীয় একটা কাজ সে খুব অনায়াসে নাকি করতে পারে।
আমি এখন যাব। বলেই ভিনগ্রহের প্রাণীটা যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিল। ঠিক এই সময় আমার টেবিলের ওপর পড়ে থাকা ছোট্ট বইটা তুলে নিল। তারপর বলল, তবে আমাদের গবেষণায় তোমাদের গ্রহের সবচেয়ে সেরা আষাঢ়ে গল্প যেটাকে মনে হয়েছে সেটা হচ্ছে, এই জাতীয় গল্পের বইগুলো।
গাধাটাকে আমি কী করে বোঝাই যে ওটা গল্পের বই না।
আমরা এর মধ্যে এ রকম অনেক বই সংগ্রহ করেছি। বলেই সে ব্যালকনির দিকে পা বাড়াল।
ওগুলো দিয়ে তোমরা কী করবে?
কিছু না। আমাদের গ্রহের আষাঢ়ে গল্প লেখকদের স্যাম্পল হিসেবে এই বইগুলো পড়তে দেব। বলেই ব্যালকনিতে রাখা তার ছোট স্পেস ডাইভটি সূক্ষ্ম শোঁ শোঁ শব্দে চালু হয়ে গেল।
আমি রীতিমতো অবাক। ভিনগ্রহের প্রাণী সম্পর্কে এত দিনের আমার উঁচু ধারণাগুলো গাধাটা সত্যি সত্যি নষ্ট করে দিয়ে গেল। আমি কোনোভাবেই ভেবে পাই না, রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহার কীভাবে ওদের চোখে পৃথিবীর সেরা আষাঢ়ে গল্প হতে পারে।
তাওহিদ মিলটন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ২৭, ২০০৯
Leave a Reply