বিলাস গরু চরাতে মাঠে এসেছে। এক হাতে বাঁশি, অন্য হাতে রিমোট কন্ট্রোল। প্রতিটি গরুর কানের কাছে একটি করে রিসিভার যন্ত্র। পাচনবাড়ির দরকার হয় না, রিমোটের বোতাম টিপেই ত্যাদড় গরুকে বশে রাখা যায়।
সবুজ দেড় বিঘা লম্বা পুষ্টিকর ঘাসে ছাওয়া মাঠটি।
পাশেই রামরতন ঘোষের মস্ত ধানক্ষেত। ক্ষেতের পাশে একটা বেলুন চেয়ারে বসে রামরতন তার রিমোট কন্ট্রোলে ক্ষেতে ধান রুইছে। রামরতনের রোবট যন্ত্রটি দেখতে অবিকল একটা বাচ্চা মেয়ের মতো। প্রোগ্রাম করে দেওয়া আছে। যন্ত্র-বালিকা ঠিকমতোই ধান রুইবে। তবে রামরতনের যন্ত্র-বালিকাটির দোষ হলো, চোখের আড়াল হলেই খানিকটা এক্কাদোক্কা খেলে নেয়। হয়তো আগে অন্য রকম প্রোগ্রাম করা ছিল, সেটা পুরোপুরি তুলে না দিয়েই নতুন প্রোগ্রাম বসিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য রামরতনের একটু ঝামেলা হচ্ছে।
বিলাস তার বেলুন চেয়ারটায় বসতে বসতে হাঁক মারল-ও রামরতন দাদা, বলি করছটা কী?
রামরতন বিরক্ত মুখে বলল, চার একর জমিতে ধান রুইতে বড় জোর আধঘণ্টা লাগার কথা। আর ওই বিচ্ছু মেয়ে ঝাড়া দুই ঘণ্টায় এক একরও পারেনি।
বিলাস তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে, স্পিডটা একটু বাড়িয়ে দাও না।
রামরতন বিরক্ত হয়ে বলে, তাহলে তো কথাই ছিল না। যেই স্পিড বাড়াব, অমনি ফাঁক ফাঁক করে বুনতে শুরু করবে। তাতে কাজ বাড়বে বই কমবে না।
যন্তরটা তাহলে তোমাকে খারাপই দিয়েছে। বদল করে নাও না কেন? রামরতন টিস্যু কাগজে মুখ মুছে বলে, সে চেষ্টা কি আর করিনি নাকি? যন্ত্র-বালিকা হলে কী হয়, মাথায় খুব বুদ্ধি। মেয়েটা বাড়িতে ঢুকেই আমাকে বাবা আর আমার গিন্নিকে মা বলে ডাকতে শুরু করেছে। এখন আমার গিন্নির এত মায়া পড়ে গেছে যে মৃগনয়নীকে ফেরত দেওয়ার কথা শুনলেই খেপে ওঠেন।
মৃগনয়নী কি ওর নাম?
আমার গিন্নির দেওয়া। ওই দেখ, আবার খেলতে লেগেছে।
বাস্তবিকই মৃগনয়নী ধান রোয়া ফেলে একটা স্কিপিং দড়িতে তিড়িং তিড়িং করে লাফাচ্ছিল। মুখে হাসি।
রামরতন রিমোটটা তুলে ধরে বোতাম টিপে মেয়েটাকে ফের কাজে লাগিয়ে দিলে বলল, সারাক্ষণ এই করতে হচ্ছে।
ফেরত না দাও, রিপ্রোগ্রামিং করিয়ে নিলেই তো পারো। ওরা ডিস্কটা ভালো করে পুঁছে আবার প্রোগ্রাম করে দেবে।
রামরতন বিমর্ষ মুখে বলে, সে চেষ্টাও কি আর করিনি? গিন্নি তাও করতে দিচ্ছে না। বলে, ও যে দুষ্টুমি করে, খেলে তাতেই আমার বেশি ভালো লাগে।
দুজনে কথা হচ্ছে এমন সময় হঠাৎ আকাশে একটা গোল গোল মেঘ দেখা দিল, আর ছ্যাড় ছ্যাড় করে বৃষ্টি হতে লাগল।
বিলাস চমকে উঠে বলে, আরে বৃষ্টি হচ্ছে কেন? এখন তো বৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। বলে রামরতন হাতের রিমোটটা উল্টে নম্বর ডায়াল করতে লাগল। রিমোটটার উল্টো পিঠটা টেলিফোনের কাজ করে।
রামরতন বলল, হাওয়া অফিস? তা ও মশাই, হক সাহেবের মাঠে এখন বৃষ্টি হওয়াচ্ছেন কেন? আমরা তো বৃষ্টি চাইনি।
হাওয়া অফিস খুব লজ্জিত হয়ে বলে, এঃ হেঃ সরি, একটু ভুল হয়ে গেছে। আসলে ওটা হওয়ার কথা সাহাগঞ্জের মাঠে। ঠিক আছে, আমরা মেঘটাকে সরিয়ে দিচ্ছি।
মেঘটা হঠাৎ একটা চক্কর খেয়ে ভোঁ করে মিলিয়ে গেল। আবার রোদ দেখা দিল।
বিলাস ক্ষুব্ধ গলায় বলে, হাওয়া অফিসটা আর মানুষ হলো না। ওরে ও বিলাস, তোর গরু যে আমার ক্ষেতে ঢুকে যাচ্ছে, এখনই সব তছনছ করবে।
বিলাস তাড়াতাড়ি রিমোট তুলে বোতাম টিপতেই কেলে গরুটা থমকে একটু শিং নাড়া দিল। তারপর সুড়সুড় করে আবার ফিরে এসে ঘাস খেতে লাগল। বিলাস বলল, রামরতনদা, তোমার রিমোটটা আমাকে দিয়ে তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও। আমি মৃগনয়নীকে সামলে রাখবখন।
বাঁচালি ভাই, এই নে, বলে রিমোটটা বিলাসকে দিয়ে রামরতন সবে চোখ বুজেছে, এমন সময় হঠাৎ মৃগনয়নী কাজ ফেলে দুড়দাড় করে দৌড়ে এল। ও বাবা!
রামরতন বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে বলল, কী বলছিস?
ভূতে ঢেলা মারছে যে!
অ্যাঁ!
এই এত বড় বড় ঢেলা। এই দেখ। বলে মৃগনয়নী একটা ঢেলা হাতের মুঠো খুলে দেখাল।
আর এই সময়েই আরও দু-চারটে ঢেলা ওদিককার ক্ষেত থেকে উড়ে এসে আশপাশে পড়ল। ব্যাপারটা নতুন নয়, আগেও দু-চারবার হয়েছে। রামরতন শুকনো মুখে বিলাসের দিকে চেয়ে বলে, কী করি বল তো!
বিলাস বলল, কার ভূত?
তা কী করে বলব?
দাঁড়াও, থিওসফিক্যাল ল্যাবরেটরিতে ফোন করে জেনে নিচ্ছি।
বিলাস ডায়াল করে জিজ্ঞেস করল, ও মশাই, হক সাহেবের মাঠে কার ভূত দৌরাত্ম্য করছে তা জানেন?
ও হলো ষষ্ঠীচরণ সাহার ভূত। ওকে চটাবেন না।
কিছু একটা করুন। ক্ষেতের কাজ যে বন্ধ হওয়ার জোগাড়।
সে আমাদের কম্ম নয়। ভূতের সঙ্গে কে এঁটে উঠবে? চোখ-কান বুজে সয়ে নিন।
বিলাস ফোন বন্ধ করে বলে, ষষ্ঠী খুড়োর ভূত। কেউ কিছু করতে পারবে না।
রামরতন একটু খিঁচিয়ে উঠে মৃগনয়নীকে বলে, তোর এত আদিখ্যেতা কিসের? ঢেলা পড়ছে তো পড়ুক না। তোর তো আর ব্যথা লাগার কথা নয়।
মৃগনয়নীর চোখ ভরে জল এল। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, না লাগেনি বুঝি! এই দেখ না, কনুইয়ের কাছটা কেমন ফুলে আছে।
সত্যিই জায়গাটা ফোলা দেখে রামরতনের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। বিলাসের দিকে চেয়ে বলল, এ কী রে? রোবটেরও যে ব্যথা লাগছে আজকাল।
বিলাস বলল, শুধু কি তাই? চোখে জল, ঠোঁটে অভিমান, নাঃ, দিনকাল যে কী রকম পড়ল!
রামরতন মৃগনয়নীকে বকবে বলে বড় বড় চোখ করে ধমকাতে যাচ্ছিল, মৃগনয়নী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, তুমি আমাকে একটুও ভালোবাস না কেন বাবা?
রামরতনের রাগ জল হয়ে গেল। ঠিক বটে, সে মানুষ আর মৃগনয়নী নিতান্তই যন্ত্র-বালিকা। কিন্তু সব সময় কি আর ওসব খেয়াল থাকে? রামরতন হাত বাড়িয়ে মৃগনয়নীকে কাছে টেনে এনে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, কাঁদিসনে মা, তোকে খুব সুন্দর একটা ডলপুতুল কিনে দেব।
বিলাস মুখটা ফিরিয়ে একটু হাসল।
[সংক্ষেপিত]
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ঃ ভারতীয় লেখক। ১৯৩৫ সালে তিনি বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেন।
সূত্রঃ প্রথম আলো, জুলাই ২০, ২০০৯
Leave a Reply